বাংলাদেশ ইতিহাস

বরিশাল জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

বরিশাল জেলার পরিচিতি ও ইতিহাসবরিশাল জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

বরিশাল

কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল বিভাগের একটি জেলা। ১৭৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শহরের পূর্ব নাম চন্দ্রদ্বীপ। ধান, নদী ,খাল -এই তিনে বরিশাল খ্যাত এই জেলা দেশের খাদ্যশষ্য উৎপাদনের একটি মূল উৎস যাকে বলা হয় বাংলার ‘ভেনিস’। এটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নদীবন্দর।

বরিশাল জেলার নামকরণের ইতিহাস:

বরিশালের নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। কিংবদন্তি থেকে জানা যায়,

• পূর্বে এখানে খুব বড় বড় শাল গাছ জন্মাতো; আর শাল গাছ থেকেই ‘বরিশাল‘ নামের উৎপত্তি। বড় বড় শালগাছের কারণে (বড়+শাল)= বরিশাল; আর এক্ষেত্রে’আইতে শাল, যাইতে শাল / তার নাম বরিশাল’ প্রবাদটি উল্লেখ্য।

• আবার, কেউ কেউ দাবি করেন যে, পর্তুগীজ বেরি ও শেলির প্রেমকাহিনীর জন্য বরিশাল নামকরণ করা হয়েছে।

• অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, গিরদে বন্দরে (গ্রেট বন্দর) ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবণের গোলা ও চৌকি ছিল। ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা বড় বড় লবণের চৌকিকে ‘বরিসল্ট’ বলতো। আবার, অনেকের ধারণা, এখানকার লবণের দানাগুলোর আকার বড় বড় ছিল বলে ‘বরিসল্ট’ বলা হতো। পরবর্তিতে এ শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল নামের উৎপত্তি হয়েছে।

বরিশাল জেলার ইতিহাস:

দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় মুসলিম আধিপত্য বিস্তার কালে রাজা দনুজমর্দন কর্তৃক ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামে এ স্বাধীন রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চল চন্দ্রদ্বীপ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এ রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে এ অঞ্চল ‘বাকলা’ নামে পরিচিত ছিল। ‘বাকলা’ অর্থ শস্য ব্যবসায়ী যা আরবী শব্দ থেকে আগত। জনৈক ড. কানুনগো নামের এক ব্যক্তি বাকলা বন্দর নির্মাণ করেন। এ সামুদ্রিক বন্দরে আরব ও পারস্যের বণিকরা বাণিজ্য করতে আসতেন। অতি প্রাচীন বৈদেশিক মানচিত্রে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নাম বড় অক্ষরে অঙ্কিত দেখা যায়।

১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ জেলা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। বাকেরগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেসি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৭৯৭ সালে রেগুলেশন-৭ অনুযায়ী বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন সময়ের প্রভাবশালী জমিদার আগা বাকের খানের নামানুসারে এ জেলার নামকরণ হয়। ১৮০১ সালের ১লা মে স্যার জন শ্যোর এ জেলার সদর দপ্তর বর্তমানে বরিশাল শহরে স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তীতে বরিশাল নামেই এ জেলা পরিচিতি পায়। ১৮১৭ সালে এজেলা একটি কালেক্টরেটে পরিণত হয়। ১৮২৯ সালে ঢাকা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে এই জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়। যে চারটি কালেক্টরেট নিয়ে ঢাকা বিভাগ বা কমিশনারশিপ গঠিত এটি তারই একটি। এটি কলকাতা থেকে প্রায় ১৮০ মাইল পূর্বে অবস্থিত ছিল। সেসময় জেলার আয়তন ছিল ৪,০৬৬ বর্গমাইল (১৮৭২ সাল অনুসারে) যা বর্তমান মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠী, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলা জুড়ে বিস্তৃত ছিল।

১৮৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘Calcutta Gadget’ থেকে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার সীমানার উল্লেখ পাওয়া যায়, তাতে বলা হয়, “বিশদভাবে এই জেলার উত্তরে ফরিদপুর, পশ্চিমে ফরিদপুর ও বলেশ্বর নদী যা যশোর থেকে পৃথক করেছে, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে মেঘনা নদী ও এর মোহনা।” বরিশালের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে তদানীন্তন বৃটিশ সরকার ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্টে ফরিদপুর ও খুলনা জেলাসহ বরিশাল বিভাগ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অবশেষে ফরিদপুর ও খুলনা জেলা বাদ দিয়ে ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য, বৃহত্তর বাকেরগঞ্জ জেলা নিয়ে বরিশাল বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়।

এ অঞ্চল ১৮০০ সাল পর্যন্ত হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসলমানদের আগমন, ধর্মান্তরিত কিছু মুসলমান এবং হিন্দুদের ব্যাপকহারে দেশ ত্যাগের ফলে মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য ঘটে। তাছাডা নিম্ন বর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত খৃস্টান সম্প্রদায়ের প্রায় ৫ হাজার জনগোষ্ঠী এ বিভাগে বসবাস করছে। এ অঞ্চলের অধিবাসীগণ এক ঐতিহ্যবাহী মানবগোষ্ঠীর বংশধর। বরিশালের কালেক্টর ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হেনরী বেভারিজ ১৮৭৬ সনে তার The District of Bakerganj- It’s History and Statistics গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘‘বাকেরগঞ্জের অধিবাসী বাঙ্গালী চরিত্রের খাঁটি নিদর্শন’।

এছাড়া বরিশালের ইতিহাস গ্রন্থে সিরাজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন ‘বাঙ্গালী জাতির আদি বাসস্থান ছিল চন্দ্রদ্বীপ’। এখানকার কুলিনসমাজ ‘বাকলা সমাজ’ নামে খ্যাত ছিল। ৭ম শতকে এখানে সামন্ত প্রথা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তালুকদার জমিদারগণ সমাজে প্রথম শ্রেণী হিসেবে বিবেচিত হতেন। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাঁওতাল, গারো, হাজং, মগ ও চাকমাদের মতো বরিশাল অঞ্চলে ‘চন্দ্রভদ্র’ নামে এক জাতির বাস।

বরিশাল জেলার ঐতিহ্য:

বাংলার শস্য ভান্ডার বরিশাল একদা ‘এগ্রিকালচারাল ম্যানচেস্টার’ হিসেবে পরিচিত ছিল। বরিশালের অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল বাংলার অর্থনীতি। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এ অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকে দিয়ে এসেছে অফুরন্ত ধন-সম্পদ আর সীমাহীন প্রাচুর্য। প্রাচীনকাল থেকে পলি গঠিত উর্বর এ অঞ্চল ছিল কৃষির জন্য উৎকৃষ্ট এবং বসবাসের জন্য উত্তম। কৃষিই ছিল এ দেশের অর্থনীতির মূল উৎস। পর্যটক রালফ ফিস ১৫৮০ সালে বাকলাকে অত্যন্ত সম্পদশালী আখ্যায়িত করে এখানকার প্রচুর চাল, কার্পাস, রেশমবস্ত্র ও সুবৃহৎ ঘরের কথা উল্লেখ করেছেন। এ কারণেই প্রাচীন কাল থেকে এ অঞ্চল বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করে আসছে।

প্রাচুর্যের দেশ বাকলায় সাগরপথে আরব বণিকগণ বাণিজ্য করতে আসতেন। আজকের মধ্যপ্রাচ্যের ন্যায় সেকালে এ ভূ-খন্ডটি ছিল বিশ্ববাসীর অন্যতম লোভনীয় অঞ্চল। বরিশাল অঞ্চলের জনগণ সত্যিকার অর্থে আরামপ্রিয় ও ভোজন বিলাসী। পারিবারিকভাবে এরা খুবই ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক। তেলে-ঝালে রকমারী সুস্বাদু খাবারের পরে একটা মিষ্টান্ন ছাড়া তাদের তৃপ্তি আসে না। এখানে খেজুরের রস, গুড়, নারিকেল, দুগ্ধছানার তৈরি পিঠার প্রকার শ’-এর কাছাকাছি।

কবি ঈশ্বরগুপ্ত বরিশালে বেডাতে এসে লিখেছেন ‘এখানে খাদ্য সুখের কথা বর্ণনা করা যায় না। এখানকার মতো উত্তম চাউল বোধ করি বঙ্গদেশে আর কোথাও নাই।’ বরিশাল বিভাগের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলো পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, বাউফলের কমলারাণীর দিঘী, বরিশালে মাধবপাশার দুর্গাসাগর দিঘী, বরিশালের চাখারের শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক জাদুঘর ও উজিরপুরের গুঠিয়া বায়তুল আমান মসজিদ, বরগুনার সোনার চর, সোনাকাটা ইত্যাদি।

পাকিস্তান আমলে বরিশাল জেলায় মোট ০৬টি মহকুমা ছিল। ১৯৬৯ সালে পটুয়াখালী ও বরগুনা মহকুমার সমন্বয়ে পটুয়াখালীতে একটি জেলা গঠন করা হয়। পরবর্তীতে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে ১৯৮৪ সালে বরগুনা একটি নতুন জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এছাড়া, তৎকালীন বরিশাল জেলার ঝালকাঠী, পিরোজপুর ও ভোলা মহকুমাকেও জেলায় উন্নীত করা হয়।

বরিশাল জেলার ভৌগোলিক অবস্থান:

বরিশাল জেলা ২১ ডিগ্রি থেকে ২৩ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯ ডিগ্রি থেকে ৯১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমায় অবস্থিত। গঙ্গা বা পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সম্মিলিত জলরাশি বাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত ব-দ্বীপের নিম্নভাগে অবস্থিত এই জেলার মোট আয়তন ২,৭৯১ বর্গকিলোমিটার। বরিশাল জেলার উত্তরে চাঁদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা; দক্ষিণে ঝালকাঠি, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা; পূর্বে লক্ষ্মীপুর জেলা ও মেঘনা নদী এবং পশ্চিমে পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জ জেলা অবস্থিত।

বরিশাল জেলার প্রধান নদ-নদী:

মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ, বিষখালী, কীর্তনখোলা, তেতুলিয়া, কালাবদর, সন্ধ্যা ইত্যাদি।

জেলার উপজেলাসমূহ:

বরিশাল জেলায় মোট ১০টি উপজেলা রয়েছে। উপজেলাগুলো হল:
• আগৈলঝাড়া উপজেলা
• গৌরনদী উপজেলা
• বাবুগঞ্জ উপজেলা
• বাকেরগঞ্জ উপজেলা
• বানারীপাড়া উপজেলা
• বরিশাল সদর উপজেলা
• মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা
• মুলাদী উপজেলা
• উজিরপুর উপজেলা
• হিজলা উপজেলা

বরিশাল জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ:

  • শাপলা বিল, উজিরপুর,বরিশাল
  • বিবির পুকুর,সদর উপজেলা
  • ব্রজমোহন কলেজ,সদর উপজেলা
  • বরিশাল মহাশ্মশান,সদর উপজেলা
  • জীবনানন্দ দাশ এর বাড়ি(ধানসিঁড়ি),সদর উপজেলা
  • অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিউদ্দীনের বাসভবন,সদর উপজেলা
  • অক্সফোর্ড মিশন গীর্জা,সদর উপজেলা
  • বেল ইসলামিয়া হসপিটাল,সদর উপজেলা

 

  • বঙ্গবন্ধু উদ্যান(বেলস পার্ক),সদর উপজেলা
  • ৩০ গোডাউন,সদর উপজেলা
  • ৩০ গোডাউন বধ্যভূমি,সদর উপজেলা
  • অশ্বিনী কুমার টাউন হল।,সদর উপজেলা
  • এবাদুল্লাহ মসজিদ,সদর উপজেলা
  • শ্বেতপদ্ম পুকুর,সদর উপজেলা
  • মুকুন্দ দাসের কালিবাড়ী,সদর উপজেলা
  • দুর্গাসাগর দিঘী,বাবুগঞ্জ উপজেলা,বরিশাল
  • বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়,বরিশাল

 

  • বাইতুল আমান জামে মসজিদ(গুঠিয়া মসজিদ),উজিরপুর উপজেলা
  • মাহিলারা মঠ।
  • সংগ্রাম কেল্লা।
  • শরিফলের দুর্গ।
  • শের-ই-বাংলা জাদুঘর।
  • শংকর মঠ।
  • মাধবপাশা জমিদার বাড়ি
  • লন্টা বাবুর দিঘী (লাকুটিয়া)।
  • কবি বিজয়গুপ্তর  মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখিত মনসা মন্দির।
  • আদম আলী হাজীর গলি।
  • পাক্কা বাড়ি দূর্গ (মেহেন্দিগঞ্জ)
  • লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, সদর উপজেলা
  • কড়াপুর মিয়া বাড়ি জামে মসজিদ, সদর, বরিশাল
  • নাটু বাবুর জমিদার বাড়ি

 

বরিশাল জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব:

• অশ্বিনী কুমার দত্ত
• কামিনী রায়
• আবুল কাশেম ফজলুল হক
• কুসুমকুমারী দাশ
• জীবনানন্দ দাশ
• আরজ আলী মাতুব্বর
• বেগম সুফিয়া কামাল
• উৎপল দত্ত
• বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর

• শহীদ তারেকশ্বর সেনগুপ্ত
• মাওলানা ফজলুল করীম
• আগা বাকের খান
• হানিফ সংকেত
• আবদুর রহমান বিশ্বাস
• সেক্টর কমান্ডার মেজর আব্দুল জলিল
• ডঃ সুরেন্দ্র নাথ
• ডঃ কামাল হোসেন
• আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
• মোশাররফ করিম

• গোলাম মুস্তাফা
• সুরকার আলতাফ মাহমুদ
• অমৃত লাল দে
• সরদার ফজলুল করিম
• মুকুন্দ দাস
• মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা
• স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ
• ফণিভুষণ দাশগুপ্ত
• মনোরঞ্জন ব্যাপারী
• রাশেদ খান মেনন

 

 

তথ্যসূত্র: জাতীয় তথ্য বাতায়ন, উইকিপিডিয়া
আরও পড়তে পারেন: পঞ্চগড় জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

Leave a Reply

%d bloggers like this: