করোনাস্বাস্থ্য

করোনা টিকা নেওয়ার আগে যা জানা প্রয়োজন

করোনা  টিকা নেওয়ার আগে যা জানা প্রয়োজনকরোনা টিকা নেওয়ার আগে যা জানা প্রয়োজন

কারা করোনা টিকা নেবেন?

কারা করোনা টিকা নিবেন। কারা নিবেন না। টিকা নিলে কী কী সাইড ইফেক্ট দেখা দেয়। সাইড ইফেক্ট দেখা দিলে কী করবেন? এই লেখাটিতে সবকিছু একেবারে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

প্রথমে জানা যাক কারা টিকা বা ভ্যাকসিন নিবেন। প্রায় সবাই করোনা টিকা নিতে পারবেন। ডায়বেটিস এর রোগী, হাই প্রেশারের রোগী, হার্টের রোগী, অ্যাজমার রোগী, কিডনির রোগী সহ বিভিন্ন রোগে যারা ভুগছেন, ওষুধ খাচ্ছেন তারা প্রায় সবাই টিকা নিতে পারবেন। কিছু ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিতে হবে। এই বিষয়গুলো নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন। প্রথমে জানা কে কে টিকা নিতে পারবেন না।

কারা করোনা টিকা নিতে পারবেন না:

 শুধু মাত্র দুই দলের মানুষ এটি টিকা নেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। প্রথম দলটি হলো অ্যালার্জি সংক্রান্ত। তবে যে কোন অ্যালার্জি নয়। খুব নির্দিষ্ট ধরনের অ্যালার্জি। টিকায় কয়েকটা নির্দিষ্ট ধরনের জিনিস ব্যবহার করা হয়েছে। সেই উপাদানগুলোতে যদি আপনার গুরুতর অ্যালার্জি থাকে তবেই সমস্যা। তাছাড়া অ্যালার্জিতে তো কোন সমস্যা নেই।

অক্সফোর্ড- অ্যাাস্ট্রাজেনেকার (Oxford- Astrazeneca / Covishield) টিকাতে যা যা আছে সেই নামগুলো হয়তো কঠিন শোনাবে। তাই আপনার জন্য সহজ একটা উপায় হলো অতীতে কোন টিকায় যদি অ্যালার্জি দেখা দিয়ে থাকে তাহলে একজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলে নিবেন। তিনি আপনাকে বলে দিবেন আপনার জন্য টিকা নেয়া নিরাপদ হবে কি না।

এরপরেও খুব অল্প কিছু মানুষের টিকা দেয়ার পরে গুরুতর অ্যালার্জি অ্যাকশান দেখা দিতে পারে। এটা হলে সাধারণত টিকা নেয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখা দেয়। এর কার্যকরি চিকিৎসা আছে। তাই টিকা নেয়ার পরে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণে থাকার কথা বলা হচ্ছে। যাতে রিঅ্যাকশন হলে সাথে সাথে চিকিৎসা করে সাজিয়ে ফেলা যায়। তাই দয়া করে টিকা নেয়ার সাথে সাথে টিকাকেন্দ্র থেকে বের হবেন না। নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। এর পাশাপাশি আর যারা টিকা নিতে পারবেন না তারা হলো শিশু-কিশোর। যাদের বয়স ১৮ এর নিচে। কারণ টিকা ১৮ বছরের কম বয়সীদের দিলে কি হয়, সে ফলাফল আমরা এখনো পাই নি। এই দুটো দলের বাইরে যারা আছেন তাদের মধ্যে প্রায় সবাই টিকা নিতে পারবেন।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কাদের ক্ষেত্রে সতর্কতা প্রয়োজন সেটা এখন বলছি। এ ক্ষেত্রে ৪টা দল আছে।

করোনা টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে যেসব সতর্কতা অবলম্বন করবেনঃ

১। বর্তমানে যদি আপনি অসুস্থ থাকেন: গায়ে প্রচন্ড জ্বর থাকে, তাপমাত্রা ১০০.৪ ফারেনহাইট এর বেশি হয় বা শরীরে কোন ইনফেকশন থাকে তাহলে সেরে উঠার পরেই টিকা গ্রহণ করবেন। তবে যদি হালকা ঠান্ডা বা সর্দি থাকে তার জন্য টিকা নেবার দেরি করার দরকার নেই।

২। আপনি যদি রক্ত পাতলা করার কোন ওষুধ সেবন করেন: যেমন- ওয়্যারফারিন (Warfarin), অ্যাপিক্সাব্যান (Apixaban) ইত্যাদি। তাহলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করবেন। কারণ কী? এই ওষুধ খেলে কি টিকা ক্ষতিকর হয়ে যায়? না টিকা আপনার জন্য ক্ষতিকর না। কিন্তু করোনা টিকা দেয়া হয় মাংপেশিতে ইনজেকশনের মাধ্যমে। আর রক্ত পাতলা থাকলে ইনজেকশনে সমস্যা হতে পারে। ব্লিডিং বা রক্তক্ষরণের একটা সম্ভাবনা থাকে। একই ভাবে যদি কারো এমন অসুখ থাকে যাতে রক্ত জমাট বাঁধতে সমস্যা হয় বা রক্ত ক্ষরণের সমস্যা হয় যেমন- হিমোফেলিয়া, তাহলে মাংসপেশিতে ইনজেকশন দিলে রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

৩। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল: সেটা অসুখের কারণেই হোক বা ওষুধের কারণে হোক। অসুখের উদাহরণ হলো এইচআইভি ইনফেকশন। ওষুধের উদাহরণ হলো ক্যান্সারের ওষুধ, উচ্চ মাত্রায় স্টেরয়েড ইত্যাদি। এমন যাদের অবস্থা তারা টিকা নিতে অবহেলা করবেন না। কারণ করোনায় আক্রান্ত হলে আপনার গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। করোনার টিকা আপনাদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। এ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেহেতু দুর্বল তাই টিকার কার্যকারিতা তুলনামূলক ভাবে কম হতে পারে।

কেন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন? ডাক্তার আপনারকে সাহায্য করবে এমন একটা সময় খুঁজে বের করতে যখন আপনার জন্য টিকা নেয়া সবচেয়ে ভালো হবে। এখানে সূক্ষ্ম কিছু বিষয় বিবেচনা করার আছে। যেমন- রক্তের নিউট্রোফিল কাউন্ট, প্লেটলেট কাউন্ট, ওষুধের কত আগে বা কত পরে টিকা নিলে ভালো হবে। তাই এই সিদ্ধান্ত নিজে নিজে না নিয়ে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে করুন।

৪। ক) যারা গর্ভবতী: তারা টিকা নেয়ার ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। প্রাথমিক গবেষণায় কোন ঝুঁকি বা প্রেগনেন্সিতে কোন সম্ভাবনা দেখা যায়নি। এই টিকার কারণে মায়ের বা গর্ভের বাচ্চার কোন ইনফেকশন হবে না। তবে তথ্য যেহেতু সীমিত তাই আরো বেশি গবেষণার প্রয়োজন তাই টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে উপকার আর ঝুঁকিগুলো তুলনা করতে হবে। ‍যুক্তরাজ্যে গর্ভবতী নারীদের টিকা দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এখনও দেয়া হচ্ছে না। তার কারণ এই না যে টিকা গর্ভবতী নারীদের জন্য অনিরাপদ বা অকার্যকর। প্রাথমিক ভাবে এ দলকে বাদ দেয়া হয়েছে। তবে এই নিয়ম পরিবর্তন হতে পারে। তাই চোখ কান খোলা রাখবেন। যখন আপনাদের জন্য টিকা অফার করা হবে, তখন ঝুঁকির চেয়ে উপকারের সম্ভাবনা বেশি থাকলে করোনা টিকা গ্রহণ করতে পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO (World Health Organization) একই পরামর্শ দিয়েছে।

খ) যারা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন: আপনারাও টিকা নিতে পারবেন। এক্ষেত্রেও তথ্যের অপ্রতুলতা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত জানা মতে কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। যুক্তরাজ্যে ব্রেস্টফীডিং মায়েদের টিকা দেয়া হচ্ছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একই পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশে আপাতত এই দলকেও বাদ দেয়া হয়েছে। তবে এই নিয়ম পরিবর্তন হতে পারে। তাই আপনারও চোখ কান খোলা রাখবেন।

এছাড়া আর কারো জন্য বিশেষ সতর্কতা নেই। টিকা নিয়ে আরো কয়েকটা প্রশ্ন অনেক বার আসে। সংক্ষেপে সেগুলোর উত্তর জেনে নিন।

যাদের একবার করোনা হয়েছে তারা টিকা নিবেন কি না?

উত্তর: হ্যাঁ, টিকা নিবেন। কারণ একবার হওয়া মানে আর কখনও হবেনা এমন নিশ্চয়তা নাই। তাই করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরও আপনি টিকা নিবেন। করোনার লক্ষণ শুরু হওয়ার অন্তত ২৮ দিন পর টিকা নিবেন। আর যদি কোন লক্ষণ ছাড়া করোনা টেস্ট পজেটিভ আসে। তাহলে যেদিন টেস্ট করিয়েছেন, সেদিন থেকে অন্তত ২৮ দিন পর টিকা নিবেন।

এই গ্যাপ রাখার কারণ হলো- টিকা নেয়ার পর অসুস্থ হলে সেটা কি টিকার কারণে হচ্ছে না কি করোনার ইনফেকশনের কারণে হচ্ছে, এ নিয়ে যাতে কনফিউশন তৈরি না হয় এবং সঠিক চিকিৎসা দেয়া যায়। যদি ২৮ দিন পরেও খুব অসুস্থ থাকেন বা হাসপাতালে ভর্তি থাকেন, তাহলে সুস্থ হওয়ার পরেই টিকা নিবেন।

আর করোনা চিকিৎসার জন্য যদি প্লাজমা থেরাপি নিয়ে থাকেন, তাহলে ডব্লিউএইচও বলছে অন্তত ৯০ দিনের ব্যবধান রাখতে।

যারা অন্য টিকা দিচ্ছেন, যেমন-হেটাটাইটিস-বি টিকা তারা করোনার টিকা নিতে পারবেন কি না?

উত্তরঃ হ্যাঁ, পারবেন। করোনার টিকার নেওয়ার মাঝে অন্য টিকার অন্তত ১৪ দিন ব্যবধান রাখার পরামর্শ দিচ্ছে ডব্লিউএইচও।

টিকা নেয়ার কারণে কি করোনা পজিটিভ আসবে কি না?

উত্তর: না। ভ্যাকসিনে সার্স-কোভিডের ভাইরাস নেই এবং এই ভ্যাকসিনের মাধ্যমে আপনার দেহে করোনা সংক্রমিত হবে না।

করোনা টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া:

এখন আসি এই টিকায় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথায়। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কেন হয় সেটা আগে জানা যাক। টিকা নেয়ার উদ্দেশ্য হলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রস্তুত করা। যাতে পরবর্তীতে শরীরে করোনা ভাইরাস ঢুকলে সেটাকে প্রতিহত করতে পারে। আমরা চাই আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা টিকাতে সাড়া দিক। যখন সেটা সাড়া দিচ্ছে তখন স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের শরীরে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

যেমন: জ্বর জ্বর লাগা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি। এগুলোকে আমরা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিনি। এগুলো দুঃশ্চিন্তার কোন কারণ নয়। এগুলো কিছু দিনেই সেরে যাবে। তাহলে  কী কী লক্ষণ দেখা দিতে পারে? খুব কমন কিছু সাইড ইফেক্ট আছে। সেগুলো হলো-যে জায়গাতে টিকা দিয়া হবে সেখানে ব্যথা হওয়া, লাল হয়ে যাওয়া, ফুলে যাওয়া, কালচে হয়ে যাওয়া, হালকা গরম থাকা, কিছুটা চুলকানি, শরীরে ক্লান্তি লাগা, শরীর ভালো না লাগা, মাংসপেশিতে ব্যথা, গিরায় ব্যথা, জ্বর ভাব, কাঁপুনি, মাথা ব্যথা, বমি ভাব ইত্যাদি। সাধারণত এসব সমস্যা বেশি দেখা দেয়।

আর একটু কম দেখা যায়, এমন কিছু সাইড ইফেক্ট আছে। ১০ জনে ১ জনের মধ্যে দেখা দিতে পারে। যে জায়গায় ইনজেকশন দেয়া হয়েছে সেই জায়গায় একটা চাকার মতো বোধ করা, বমি হওয়া, গায়ে জ্বর, সর্দি- কাশি, গলা ব্যথা হওয়া।

আরও কম দেখা যায়, এমন কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হলো- মাথা ঘুরানো, রুচি কমে যাওয়া বা পেটে ব্যাথা, শিরাগ্রন্থি  ফুলে যাওয়া, অতিরিক্ত ঘাম, গায়ে র‌্যাশ বা চুলকানি। এগুলো প্রতি ১০০ জনে ১ জনের দেখা দিতে পারে।

করোনা টীকা নেওয়ার পর সাইড ইফেক্ট দেখা দিলে কী করবেন?

প্রথম কথা হলো ঘাবড়ে যাবেন না। আগেই জেনেছেন, এগুলো স্বাভাবিক। কয়েকদিনের মধ্যেই সেরে  যাবে। ব্যথা আর জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল খেতে পারেন। ১০০০ মিলিগ্রাম খাবেন অর্থাৎ, ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট হলে ২টা ট্যাবলেট খাবেন। প্যারিসিটামল খেলে টিকার কার্যকারিতায় কোন প্রভাব ফেলবে না। তাই নিজেকে কষ্ট না দিয়ে প্রয়োজনে প্যারাসিটামল খেতে পারেন। আর জ্বর সাধারণত ৪৮ ঘণ্টায় সেরে যায়। যে লক্ষণগুলোর কথা আলোচনা করা হলো, সেগুলোর কোনটা যদি আপনার জন্য গুরুতর হয় বা আপনি যদি খুব অসুস্থ বোধ করেন, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।

করোনা টিকা নেওয়ার পর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া না হলে:

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া না হলেও ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই। তার মানে এই নয় যে, টিকা আপনার শরীরে কাজ করছে না।

আর মনে রাখবেন কোন টিকাই শতভাগ কার্যকর নয়। তাই টিকা নিলেও আমাদেরকে স্বাস্থ্য সচেতনতা মেনে চলতে হবে। দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। নিয়মিত হাত ধুতে হবে। আর মাস্ক পরতে হবে।

 

উৎসঃ ডা. তাসনিম জারা, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও জানুনঃ করোনা আক্রান্ত হলে বাসায় যেসব নিয়ম মেনে চলবেন।

 

Leave a Reply

%d bloggers like this: