কোমর ব্যথা :
পৃথিবীতে এমন মানুষ হয়তো খুব কমই পাওয়া যাবে যিনি তার জীবনে একবারও কোমরে ব্যথা অনুভব করেননি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর শতকরা ৮০ ভাগ লোক জীবনে কোন না কোন সময় কোমর ব্যথায় আক্রান্ত হোন। আধুনিক এই যুগেও কোমর ব্যথা একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বাস্থ্য সমস্যা।
কোমরে আছে ৩০ টির বেশি হাড় এবং ১০০ -এর বেশি নার্ভ, মাংসপেশী, লিগামেন্ট ও টেন্ডন। এ সমস্ত কিছু নিয়ে কোমর খুবই সংবেদনশীল অবস্থায় থাকে। এগুলোর কোন একটি বা একাধিক উপাদানের সমস্যা হলে কোমর ব্যথা হতে পারে।
কোমর ব্যথা যে কারণে হয়
- পেশি, হাড়, জোড়া, লিগামেন্ট, জোড়ার আবরণ, ডিস্ক (দুই কশেরুকার মধ্যে থাকে) ও স্নায়ুর রোগ বা ইনজুরি।
বুক, পেট ও তলপেটের মধ্যকার বিভিন্ন অঙ্গের সমস্যার জন্য কোমরব্যথা হতে পারে। - যাঁরা অফিসে দীর্ঘক্ষণ বসে একই ভঙ্গিতে কাজ করেন। এতে দেখা যায়, কোমরে ব্যথা প্রচণ্ড হয়ে থাকে।
- বসার চেয়ার টেবিল ঠিকমতো না হলে বা ঠিকমতো না বসলে বা সামনে-পেছনে ঝুঁকে বসলে কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- দীর্ঘক্ষণ ড্রাইভিং করলে বা বেশি সামনে ঝুঁকে গাড়ি চালালে কোমর ব্যথা হতে পারে। ড্রাইভিংয়ের সময় পেছনে কিছু সাপোর্ট নেওয়া উচিত।
- যাঁরা শুয়ে বা কাত হয়ে বই পড়েন বা অন্য কাজ করেন, তাঁদের মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ব্যথা অনুভূত হয়।
- অনেকেই আছেন যাঁরা কোনো ভারী জিনিস সঠিক নিয়মে তোলেন না। ফলে মেরুদণ্ডে অস্বাভাবিক চাপ পড়ে এবং তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যথা হয়।
- অন্যান্য কারণের মধ্যে বয়সজনিত মেরুদণ্ডে ক্ষয় বা বৃদ্ধি, অস্টিওআথ্র্যাটিস বা গেঁটে বাত, অস্টিওপোরেসিস, এনকাইলজিং স্পনডাইলাইটিস, মেরুদণ্ডের স্নায়ুবিক সমস্যা, টিউমার, ক্যান্সার, বোন টিবি।
- কোমরের মাংসে সমস্যা,বিভিন্ন ভিসেরার রোগ বা ইনফেকশন, বিভিন্ন স্ত্রীরোগজনিত সমস্যা, মেরুদণ্ডের রক্তবাহী নালির সমস্যা, অপুষ্টিজনিত সমস্যা, মেদ বা ভুড়ি, অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি।
কোমর ব্যথা মানেই কিডনি সমস্যা নয়
কোমরের পেছন দিকে হালকা চিনচিনে ব্যথা -এমন উপসর্গ নিয়ে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে ছোটেন চিকিৎসকের কাছে। আমার কিডনি কি খারাপ হয়ে গেল? শুনেছি কিডনির সমস্যায় পেছনে ব্যথা হয়? কোমর ব্যথার বেশির ভাগ রোগী মনে করেন, তাঁদের কিডনিতে সমস্যা হয়েছে। কিন্তু সত্যিটা হল, কিডনিতে পাথর বা খারাপ ধরনের সংক্রমণ না হলে কোমর ব্যথা করার কথা নয়। কোনো রকম ব্যথা-বেদনা ছাড়াও কিডনি খারাপ হতে পারে। কোমর ব্যথারও আছে নানা কারণ ও উৎস।
কিডনি রোগের উপসর্গ
- কিডনিজনিত ব্যথা সাধারণত মেরুদণ্ড থেকে একটু দূরে ডান বা বাম পাশে হয়। এটি পেছনের পাঁজরের নিচের অংশে অনুভূত হওয়ার কথা। এই ব্যথা নড়াচড়া করে এবং কোমরের দুই পাশেও যেতে পারে। এই ব্যথা থেকে থেকে আসে, শোয়া-বসা বা কোনো কিছুতেই আরাম মেলে না।
- কিডনির সমস্যায় ব্যথা মূল উপসর্গ নয়, এতে শরীরে পানি আসা, দুর্বলতা, অরুচি, বমির ভাব দেখা দেয়।
- সংক্রমণ হলে জ্বর হতে পারে এই ব্যথার সঙ্গে।
- প্রস্রাব ঘোলাটে হয়, দুর্গন্ধ বা রক্ত থাকতে পারে।
- প্রস্রাবের পরিমাণ কম-বেশি হয়। রক্তশূন্যতা থাকতে পারে। কিডনি খারাপ হওয়ার পেছনে দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, সংক্রমণ, ব্যথানাশক বড়ি খাওয়া ইত্যাদির ইতিহাস থাকবে।
কোমর ব্যথার সাধারণ লক্ষণ
- বেশির ভাগ কোমর ব্যথা সাধারণত মাংসপেশি, মেরুদণ্ডের হাড়, ডিস্ক, সন্ধি ও স্নায়ুসম্পর্কিত।
- এটি নির্দিষ্ট অংশ জুড়ে হয়।
- মেরুদণ্ডের নড়াচড়া যেমন ওঠাবসা, সামনে ঝোঁকা, হাঁটা বা দাঁড়ানো, অনেকক্ষণ ধরে কাজ করা বা শুয়ে থাকার সঙ্গে এই ব্যথা বাড়ে-কমে।
- সাধারণত জ্বর হয় না (তবে টিউমার, টিবি ইত্যাদি ছাড়া)। দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, অরুচি, বমির ভাব ইত্যাদি আনুষঙ্গিক সমস্যা সাধারণত থাকে না।
- সাধারণত বিশ্রাম ও ব্যথানাশক ওষুধ সেবনে ভালো হয়; বন্ধ করলে ব্যথা আবার ফিরে আসে।
কোমর ব্যথার চিকিৎসা
দৈনন্দিন কাজে সতর্কতা
নিচ থেকে কিছু তোলার সময়-
- কোমর ভাঁজ করে কিংবা ঝুঁকে তুলবেন না। হাঁটু ভাঁজ করে তুলুন।
কোনো কিছু বহন করার সময়-
- ঘাড়ের ওপর কিছু তুলবেন না।
- ভারী জিনিস শরীরের কাছাকাছি রাখুন।
- পিঠের ওপর ভারি কিছু বহন করার সময় সামনের দিকে ঝুঁকে বহন করুন।
শোয়ার সময়-
- উপুড় হয়ে শোবেন না। ভাঙ্গা খাট, ফোম বা স্প্রিংয়ের খাটে শোবেন না।
- সমান তোশক ব্যবহার করুন।
- বিছানা শক্ত, চওড়া ও সমান হতে হবে। শক্ত বিছানা বলতে সমান কিছুর ওপর পাতলা তোশক বিছানোকে বোঝায়।
দাঁড়িয়ে থাকার সময়-
- ১০ মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
- হাঁটু না ভেঙে সামনের দিকে ঝুঁকবেন না।
- দীর্ঘক্ষণ হাঁটতে বা দাঁড়াতে হলে উঁচু হিল পরবেন না।
- অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হলে কিছুক্ষণ পর পর শরীরের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে নিন।
- দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলে ছোট ফুট রেস্ট ব্যবহার করুন।
বসে থাকার সময়-
- আপনার চেয়ারটি টেবিল থেকে বেশি দূরে নেবেন না।
- সামনে ঝুঁকে কাজ করবেন না।
- কোমরের পেছনে সাপোর্ট দিন।
- এমনভাবে বসুন যাতে ঊরু মাটির সমান্তরালে থাকে।
- নরম গদি বা স্প্রিংযুক্ত সোফা বা চেয়ারে বসবেন না।
যানবাহনে চড়ার সময়-
- গাড়ি চলানোর সময় স্টিয়ারিং হুইল থেকে দূরে সরে বসবেন না। সোজা হয়ে বসুন।
- ভ্রমণে ব্যথার সময় লাম্বার করসেট ব্যবহার করুন।
কোমর ব্যথা বেশি হলে বিছানা থেকে শোয়া ও ওঠার নিয়ম
- চিৎ হয়ে শুয়ে এক হাঁটু ভাঁজ করুন।
- এবার অন্য হাঁটুটি ভাঁজ করুন। হাত দুটি বিছানায় রাখুন।
- এবার ধীরে ধীরে এক পাশ কাত হোন।
- পা দু’টি বিছানা থেকে ঝুলিয়ে দিন, এবার কাত হওয়া দিকের হাতের কনুই এবং অপর হাতের তালুর ওপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসুন।
- দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে বসুন এবং মেঝেতে পা রাখুন।
- এবার দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে দাঁড়ান।
মেয়েরা যেসব নিয়মকানুন মেনে চলবেন
- অল্প হিলের জুতো বা স্যান্ডেল পরুন, বিভিন্ন জুতোর হিলের উচ্চতা বিভিন্ন না হওয়াই উচিত।
- তরকারি কাটা, মসলা পেষা, কাপড় কাচা ও ঘর মোছার সময় মেরুদ- সাধারণ অবস্থায় এবং কোমর সোজা রাখুন।
- কোমর ঝুঁকে বাচ্চাকে কোলে নেবেন না। ঝাড়ু দেয়া, টিউবওয়েল চাপার সময় কোমর সোজা রাখবেন।
- মার্কেটিং বা শপিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হলে ১০ থেকে ১৫ মিনিট দাঁড়ানো বা হাঁটার পরে বিশ্রামের জন্য একটু বসবেন।
- বিছানা গোছানোর সময় কোমর ভাঁজ না করে বরং হাঁটু ভেঙে বসা উচিত।
ওজন কমান, খাদ্যাভাস পরিবর্তন করুন
গরু, খাসির মাংস, ডালজাতীয় খাবার, মিষ্টিজাতীয় খাবার, তৈলাক্ত খাবার খাদ্য তালিকা থেকে কমিয়ে শাকসবজি, তরিতরকারি, ফলমূল খাদ্য তালিকায় বেশি করে রাখুন। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন এবং যাদের দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস আছে, তা বন্ধ করে রাতে শিগগিরই শুয়ে পড়ুন।
আরও জানতে পড়ুন: করোনা ভাইরাস ও মহামারির ইতিহাস
তথ্যসূত্র: স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট, স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞ দের পরামর্শ অবলম্বনে।