স্বাস্থ্য

বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত বয়স কত? যা যা জানা আপনার জন্য সহায়ক।

বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত বয়স কত?বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত বয়স কত?

বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত বয়স

কত? বিয়ের কত দিনের মধ্যে বাচ্চা নিলে ভালো? সাধারণত বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত বয়স নিয়ে এই প্রশ্নগুলোর সোজাসাপটা একটা উত্তর দেওয়া হয় যে, ৩০ বছর বয়সের আগে বাচ্চা নিয়ে নিবেন। তবে এই উত্তরটা সবার জন্য সঠিক নয়। কারণ আপনি হয়তো একটা, দুইটা বা তিনটা বাচ্চা চান। কয়টা বাচ্চা চান তার উপর ভিত্তি করে বয়সটা ভিন্ন হবে। একটা বাচ্চা চাইলে যখন বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করা প্রয়োজন, তিনটা বাচ্চা চাইলে তার থেকে অনেক বছর আগেই চেষ্টা করা প্রয়োজন। আরও জানা প্রয়োজন, আপনার সন্তান ধারনের সমস্যা আছে কি না? কিছু লক্ষণ থাকলে আগে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া ভালো।  এর সাথে আরও আছে আপনার জীবনের অন্যান্য হিসেব। কেউ কেউ চান পড়াশুনা শেষ করে বাচ্চা নিব, অনেকেই ক্যারিয়ারটা একটু গড়ে নিতে চান। তাই অনেকেরই প্রশ্ন থাকে প্রথম বাচ্চা নেওয়ার আগে কত দিন অপেক্ষা করা যায়?

বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত বয়স কত তা এই লেখায় সবকিছু বিস্তারিত  বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো । এতে করে আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হবে। প্রথমে বুঝতে হবে যে,আমাদের বাচ্চা নেওয়ার ক্ষমতা কোন বয়সে কতটুকু কমতে থাকে। তারপর বলবো সন্তান নেওয়ার জন্য কত বছর বয়সে চেষ্টা শুরু করবেন। সেটা এক, দুই বা তিন সন্তান চাইলে কতটুকু ভিন্ন হবে। আর শেষে বলবো কোন কোন লক্ষণ থাকলে সন্তান ধারণের সমস্যা হতে পারে এবং এক্ষেত্রে কী করবেন?

বাচ্চা নেওয়ার ক্ষমতা কখন থেকে কত দ্রুত কমে?

পুরুষের ক্ষেত্রে বয়স ৫০ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রজনন ক্ষমতা খুব একটা কমে না। তবে নারীদের ক্ষেত্রে বয়সের সাথে সাথে সন্তান ধারণের ক্ষমতা অনেকটা কমে যায়। ৩০ বছর পর্যন্ত সন্তান ধারণের ক্ষমতা খুবই ভালো থাকে। আর ৩০ বছর এর পরে তা দ্রুত কমতে শুরু করে এবং ৩৫ এর পরে তা অনেক কমে যায়। নারীদের ক্ষেত্রে প্রজনন ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণ হলো একজন নারী জন্মের সময় যে ডিম্বাণুগুলো নিয়ে জন্মে সেটাই তার সন্তান ধারণের পুঁজি এবং বয়সের সাথে সাথে তা কমতে থাকে। জন্মের পরে নারীর শরীরে আর নতুন করে ডিম্বাণু তৈরী হয় না।

জন্ম গ্রহণের সময় প্রায় ১০-২০ লাখ ডিম্বাণু থাকে। সেটা বয়স ৩৫ হতে হতে কমে দাড়ায় ২৫ হাজারে। অন্যদিকে পুরুষ শরীরে শুক্রাণু নিয়ে জন্মায় না বয়সসন্ধিকালে শুক্রাণু তৈরি হওয়া শুরু হয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের শরীর প্রতিদিন প্রায় ৩০ কোটি শুক্রাণু তৈরী হয়। এখন আপনার মনে হতে পারে ২০-৩০ বছর পর্যন্ত তো নারীর সন্তান ধারনের ক্ষমতা একই রকম থাকে তাহলে ৩০ বছর বয়সে বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা শুরু করলেই হবে। ব্যাপারটা তেমন না। কয়টা বাচ্চা নিতে চান সেই অনুযায়ী আপনার আরও আগে চেষ্টা শুরু করা লাগতে পারে। সেই বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত বয়স টা কত সেই আলোচনায় এখন আসা যাক।

আপনি একটি সন্তান চানঃ আপনি যদি ৩২ বছর বয়সে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেন তাহলে আপনার সফলতার সম্ভাবনা ৯০%। এই বয়সের পর থেকে সেই সম্ভাবনা কমতে থাকবে। ৩৭ বছর বয়স হয়ে গেলে সম্ভাবনা নেমে আসে ৭৫% এ। আর বয়স ৪১ হয়ে গেলে সম্ভাবনা থাকে ৫০%।

আপনি যদি ‍দুই সন্তান চানঃ তাহলে ২৭ বছর বয়স থেকে চেষ্টা শুরু করলে সফলতার সম্ভাবনা থাকে ৯০%। বয়স ৩৪ হয়ে গেলে সেই সম্ভাবনা কমে হয় ৭৫%। আর বয়স যদি ৩৮ হয়ে যায় তাহলে সম্ভাবনা নেমে আসে ৫০% এ।

আপনি যদি ‍তিন সন্তান চানঃ তিন সন্তানের হিসাবে যাওয়ার আগে কিছু বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া যাক। সন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনি ৯০% সফলতা চান নাকি ৭৫% বা ৫০% সফলতা চান এটা আপনার সিদ্ধান্ত। গাইড হিসাবে বলা যায়, যে সকল দম্পতির কাছে সন্তান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, নির্দিষ্ট সংখ্যক সন্তান গ্রহণের জন্য যা কিছু করা দরকার, যা কিছু ছাড় দেওয়া দরকার তারা সব করতে রাজি, এমন দম্পতি চাইবেন সেই বয়সে চেষ্টা শুরু করতে যাতে তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অন্তত ৯০%।

আবার কিছু দম্পতি এমন হতে পারে যারা ২ বা ৩ সন্তান চান কিন্তু একদম সব ছেড়েছুড়ে না। জীবনে আরও কিছু বিষয় তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারা হয়তো এমন বয়সে চেষ্টা শুরু করতে চাইবেন যখন যে কয়টি বাচ্চা তারা চান তাতে সফলতার সম্ভাবনা ৭৫% থাকে। এখন আসি তিন সন্তান চাইলে কোন বয়সে চেষ্টা শুরু করতে হবে। ২৩ বছর বয়সে চেষ্টা শুরু করলে সম্ভাবনা থাকে ৯০%। ৩১ বছর বয়সে শুরু করলে সেই সম্ভাবনা এসে দাড়ায় ৭৫%। আর ৩৫ বছর বয়সে শুরু করলে সম্ভাবনা থাকে ৫০%।

আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা, এই যে বয়সগুলো বলা হলো  আপনাকে ধারণা দেওয়ার জন্য। যা বিজ্ঞানের কথা বায়োলজির কথা। ছকে হিসাব দিয়েতো আর জীবন চলে না। বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত আপনি অনেক কিছু বিবেচনা করে নিবেন। সিদ্ধান্তটা একান্ত আপনার এবং আপনার পার্টনারের। এই লেখার উদ্দেশ্য হলো আপনি যখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তখন যেন আপনার হাতে এই তথ্যগুলো থাকে। আর আপনি যখনই বাচ্চা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিন সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু সেটা নিয়ে আপনার যেন একটা বাস্তব সম্মত ধারণা তৈরী হয়। আর যে বয়সেই থাকেন না কেন, কিছু নিয়ম মেনে চললে সন্তান ধারণের সম্ভাবনা বাড়ে। সঠিক সময়ে সহবাস করা, ওজন ঠিক রাখা, রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান না করা এই কাজগুলো আপনাকে অনেক সহায়তা করবে।

কী কী লক্ষণ দেখা দিলে গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দিতে পারে?

ভয় পাবেন না। এই লক্ষণগুলো থাকলে যে, সন্তান হবে না, বিষয়টা তা নয়। এটা সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা মাত্র। এই লক্ষণগুলো থাকলে দেরি না করে আগে থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। আপনার হয়তো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা লাগতে পারে। একটু আগে থেকেই সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে এটা ভয়ের কিছু নয়। লক্ষণগুলো বলছি-যে নারীর নিয়মিত মাসিক হয়, যদি সেটাতে পরিবর্তন আসে তখন তা একটা সমস্যার ইঙ্গিত করতে পারে।

যেমন- মাসিক যদি অনিয়মিত হয়ে যায় কিংবা লম্বা সময় পরে পরে হয় বা কয়েক মাস বন্ধ থাকে তাহলে নারীর শরীরে প্রতি মাসে যে একটা করে ডিম ফোটে সেখানে হয়তো সমস্যা হচ্ছে। এটা পলিসিস্‌টিক ওভারি সিনড্রোম (polycystic ovary syndrome) বা সংক্ষেপে পিসিওস (pcos)  রোগের লক্ষণ হতে পারে। এই রোগে নারীদের মুখে, বুকে, পিঠে অতিরিক্ত লোম দেখা দিতে পারে, ত্বক তেল তেলে হয়ে যেতে পারে, পিম্পল দেখা দিতে পারে। সবার সব লক্ষণ দেখা দেয়ও না। তবে এই রোগটা সন্তান ধারণে সমস্যা হওয়ার সব চেয়ে কমন কারণগুলোর একটি।

মাসিকের সময় যদি অনেক রক্ত যায় বা তলপেট খুব ব্যথা করে, সেটা জরায়ুতে ফাইব্রয়েড (Fibroid)  বা এক ধরনের টিউমারের লক্ষণ হতে পারে। এই টিউমার জরায়ুর গায়ে ডিম্বাণুকে বসতে দেয় না। ফাইব্রয়েড এর ফলে ডিম্বনালীর মুখ আটকে যেতে পারে তাই ডিমটা জরায়ুতে পৌঁছায় না। এসব কারণে সন্তান ধারণে সমস্যা হতে পারে। আবার মাসিকের সময় তলপেটে অনেক ব্যথা হওয়া বা অনেক রক্ত যাওয়া এন্ডোমিট্রিওসিস (endometriosis) নামের একটা রোগের লক্ষণও হতে পারে। এই রোগের অন্যতম প্রধান জটিলতা হলো গর্ভধারণে সমস্যা হওয়া। এমন আরও কিছু রোগ আছে যার লক্ষণ দেখা দিলে আগে থেকেই চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।

লক্ষণগুলো হলো-

১। মাসিক অনিয়মিত হওয়া।

২। ৩৫ দিনের বেশি সময় পর পর মাসিক শুরু হওয়া।

৩। ২১ দিনের কম সময় পরে মাসিক শুরু হওয়া।

৪। মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া।

৫। মাসিকের সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়া।

৬। মাসিকের সময় প্রচণ্ড ব্যথা হওয়া।

তাছাড়াও আপনার যদি অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। সেগুলোও সন্তান ধারণের সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে পারে। যেমন, থাইরয়েড এর রোগ। থাইরয়েড যদি কম কাজ করে তাহলে নারীর শরীরে ডিম ফোটা নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই রোগের কমন লক্ষণগুলো হচ্ছে ক্লান্তি, ওজন বেড়ে যাওয়া কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি। অনেকেই জানেন না যে, তারা এই রোগে ভুগছেন। তাই আপনার যদি মনে হয় আপনি কোন একটা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন, একজন চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিবেন। পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা কমলে সাধারণত বাইরে থেকে কোন লক্ষণ দেখা যায় না। বীর্য পরীক্ষা করলে বোঝা যায়। তাই অনেক দিন চেষ্টা করার পরেও সফলতা নাও আসতে পারে। আশা করছি, বাচ্চা নেওয়ার উপযুক্ত বয়স নিয়ে উপর্যুক্ত তথ্যগুলো আপনার জন্য সহায়ক হবে।

 

উৎসঃ ডা তাসনিম জারা, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুনঃ সন্তান নেওয়ার আবশ্যকীয় পূর্বপ্রস্তুতি

Leave a Reply

%d bloggers like this: