বাংলাদেশ ইতিহাস

রাজশাহী জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

রাজশাহী জেলার পরিচিতি ও ইতিহাসরাজশাহী জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

রাজশাহী

পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐত্যিহবাহী জেলা। রাজশাহী তার আকর্ষণীয় রেশমীবস্ত্র, আম, লিচু এবং মিষ্টান্নসামগ্রীর জন্য প্রসিদ্ধ। রেশমীবস্ত্রের কারণে রাজশাহীকে “রেশমনগরী” বা “সিল্কনগরী” নামে ডাকা হয় এবং এই  জেলা রেশম বস্ত্র উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সুপরিচিত।

রাজশাহী জেলার নামকরণের ইতিহাস

• এই জেলার নামকরণ নিয়ে প্রচুর মতপার্থক্য রয়েছে। রাজাশাহী শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দুটি ভিন্ন ভাষার একই অর্থবোধক দুটি শব্দের সংযোজন পরিলক্ষিত হয়। সংস্কৃত ‘রাজ’ ও ফারসি ‘শাহ’ এর বিশেষণ ‘শাহী’ শব্দযোগে ‘রাজশাহী’ শব্দের উদ্ভব, যার অর্থ একই অর্থাৎ রাজা বা রাজা-রাজকীয় বা বাদশাহ বা বাদশাহী।

• তবে ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে রাজশাহী রাণী ভবানীর দেয়া নাম। অবশ্য মিঃ গ্রান্ট লিখেছেন যে, রাণী ভবানীর জমিদারীকেই রাজশাহী বলা হতো এবং এই চাকলার বন্দোবস্তের কালে রাজশাহী নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। পদ্মার উত্তরাঞ্চল বিস্তীর্ন এলাকা নিয়ে পাবনা পেরিয়ে ঢাকা পর্যন্ত এমনকি নদীয়া, যশোর, বর্ধমান, বীরভূম নিয়ে এই এলাকা রাজশাহী চাকলা নামে অভিহিত হয়। অনুমান করা হয় ‘রামপুর’ এবং ‘বোয়ালিয়া’ নামক দু’টি গ্রামের সমন্বয়ে এই শহর গ’ড়ে উঠেছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘রামপুর-বোয়ালিয়া’ নামে অভিহিত হলেও পরবর্তীতে রাজশাহী নামটিই সর্ব সাধারণের নিকট সমধিক পরিচিতি লাভ করে।

রাজশাহী জেলার ইতিহাস

প্রাচীন ও মধ্যযুগ

রাজশাহী ছিল প্রাচীন বাংলার পুন্ড্র সাম্রাজ্যের অংশ। বিখ্যাত সেন বংশের রাজা বিজয় সেনের সময়ের রাজধানী বর্তমান  শহর থেকে মাত্র ৯ কিমি দূরে অবস্থিত ছিল। মধ্যযুগে বর্তমান রাজশাহী পরিচিত ছিল রামপুর বোয়ালিয়া নামে। এর সূত্র ধরে এখনও রাজশাহী শহরের একটি থানার নাম বোয়ালিয়া।

আধুনিক যুগ

ঐতিহাসিক তথ্য মোতাবেক বাংলার নবাবী আমল ১৭০০ হতে ১৭২৫ খ্রিষ্টাব্দের সময়কালের মধ্যে মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদকুলী খাঁন গোটা বাংলাদেশকে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেন। যার মধ্যে চাকলা রাজশাহী নামে একটি বৃহৎ বিস্তৃত এলাকা নির্ধারিত হয়। প্রবাহিত পদ্মা নদীর এই  চাকলাকে তিনি উত্তরে বর্তমান রাজশাহী ও দক্ষিণে মুর্শিদাবাদের সঙ্গে অপর অংশ  নিজ চাকলা নামে অভিহিত করেন।

প্রথমে সমগ্র চাকলায়ের রাজস্ব আদায় করতেন হিন্দু রাজ জমিদার উদয় নারায়ণ। তিনি ছিলেন মুর্শিদকুলী খানের একান্ত প্রীতিভাজন ব্যক্তি যে কারণে নবাব তাঁকে রাজা উপাধি প্রদান করেন। এর পরেই পদ্মার দক্ষিণ চাকলা রাজশাহী নামে এক বিস্তৃত এলাকা যা সমগ্র রাজশাহী ও পাবনার অংশ নিয়ে অবস্থিত যেটা ১৭১৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খান নাটোরের রামজীবনের নিকট বন্দোবস্ত প্রদান করেন। এই জমিদারী পরবর্তীতে নাটোরের রানী ভবানীর শাসনে আসে ও বহু অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃতি লাভ করে। রামজীবন প্রথম নাটোর রাজ যিনি ১৭৩০ সালে মারা গেলে তার দত্তকপুত্র রামকান্ত রাজা হন।

কিন্তু ১৭৫১ সালে রামকান্তের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ভবানী দেবী রানী ভবানী নামে উত্তরাধিকার লাভ করেন। তবে অনেক ভাষ্যকারের মতে প্রথম রাজা উদয় নারায়ণের ওপর প্রীতিবশত এই চাকলার নাম রাজশাহী করেন নবাব মুর্শিদকুলী খান। কিন্তু ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রের মতে “রানী ভবানীর দেয়া নাম রাজশাহী। অবশ্য মি. গ্রান্ট লিখেছেন যে রানী ভবানীর জমিদারীকেই রাজশাহী বলা হতো এবং এই চাকলার বন্দোবস্তরকালে রাজশাহী নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

পদ্মার উত্তরাঞ্চল প্রায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাবনা পেরিয়ে ঢাকা পর্যন্ত এমনকি নদীয়া, যশোর,বর্ধমান,বীরভূম নিয়ে এই এলাকা রাজশাহী চাকলা নামে অভিহিত হয়। উদয় নারায়ণের পরে রামজীবন (নাটোর রাজ প্রতিষ্ঠাতা) বন্দোবস্ত পান। যার পরে রামজীবন ১৭৩০ সালে মারা গেলে রামকান্ত রাজা হন। যার মৃত্যু হয় ১৭৫১ সালে। এবং একুশ বছর পরেই রাজ্য লাভ করেন রানী ভবানী যার সময়ে নাটোর রাজ্যের অধীন বিশাল সম্পত্তি লাভ ঘটে। অতএব, মি. গান্টের অভিমত রাজশাহীর নাম নাটোর রাজ্যের স্বর্ণ যুগে রানী ভবানীর নামানুসারে করা হয়।

১৭৬৫ হতে ১৭৯৩ সালতক বহু জেলা নিয়ে বিস্তৃত ছিল রাজশাহী জেলা। পরে ইংরেজ আমলে শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে রাজশাহীর অংশ হতেই পাবনা, বগুড়া, যশোর নদীয়া জেলার উৎপত্তি। পদ্মার দক্ষিণাঞ্চল মুর্শিদাবাদ সংলগ্ন বিধায় ‘নিজ চাকলা’ নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৪৭ সালের পূর্বে দেশ বিভাগের আগে বোয়ালিয়া থানাধীন পদ্মার অনেক অংশ চিহ্নিত ছিল, যার মধ্যে বাঁশগাড়া, চরসরন্দাজপুর, চরখিদিরপুর উল্লেখযোগ্য। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়ায় রাজা জমিদার ও মহারাজাদের প্রভাব বিস্তার ঘটে।

১৭৮৬ সালে এর আয়তন ছিল ১৩ হাজার বর্গমাইল অর্থাৎ পাবনা, বগুড়া, রংপুর, মালদহ ও দিনাজপুরের অনেক অংশ রাজশাহীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজস্ব আদায়ের জটিলতা দেখা দিলে ১৭৯৩ সালে এর সীমানা পরিবর্তন হয়- গঙ্গার দক্ষিণাংশ মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, ও যশোরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে সীমানা আরও সংকুচিত করা হয় ১৮১৩ সালে। রাজশাহী হতে চাঁপাই, রাহনপুর ও পুর্নিয়ার এবং দিনাজপুরের অংশ নিয়ে মালদহ, ১৮২১ সালে আদমদীঘি, নায়োকিল্লা, শেরপুর ও বগুড়া রাজশাহী হতে পৃথক হয় এবং রংপুর ও দিনাজপুরের ১২টি থানা নিয়ে বগুড়া জেলা হয়।

নাটোর তখন রাজশাহীর সদর দপ্তর। কারণ নাটোরের রাজবংশ সমগ্র অঞ্চলের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ছোট নাগপুর, ভাগলপুর, পুর্নিয়া, বিহারের অংশ হলেও রাজশাহীর অন্তর্গত ছিল। তৎকালে বাঙ্গলা প্রেসিডেন্সির সমগ্র এলাকার এক-তৃতীয়াংশ ছিল এর অন্তর্গত। কোনো এক বিদেশী পর্যটকের বিবরণ মতে  সমগ্র এলাকার পরিদর্শনে তার সময় লেগেছিল একটানা পঁয়ত্রিশ দিন। রানী ভবানীর রাজ্য ছিল আয়তনে সর্ববৃহৎ।

যার পরগনা ছিল ১৬৪টি ও মোট রাজস্ব আদায় হতো আঠার লক্ষ তেপান্ন হাজার টাকার উর্ধ্বে। এই রাজকীয় প্রভাব বলয়ে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত নাটোরই ছিল রাজশাহীর প্রধান নগর ও সদর দপ্তর যা পরবর্তীতে রাজশাহীতে স্থানান্তরিত হয়। এই শহরকে কেন্দ্র করে ১৭৭২ সালে জেলা গঠন করা হয়। ১৮৭৬ সালে গঠিত হয় রাজশাহী পৌরসভা। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে এটি সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাজশাহী তথা সারা বাংলাদেশের সবচেয়ে স্মরণীয় এবং গৌরবময় অধ্যায় হচ্ছে রাজশাহী পুলিশ লাইনের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ যুদ্ধ। ১৯৭১ এর অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি জনপদে আন্দোলনরত ছাত্র জনতার সাথে সকল স্তরের পুলিশ সদস্যগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। এ সকল ঘটনা সমূহ জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ের সংগ্রামী জনগণকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে তোলে।

২৫শে মার্চের কালো রাত্রে রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণের সংবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। রাজশাহী পুলিশ লাইন সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হতে পারে এমন আশঙ্কা বাঙালী পুলিশ সদস্যদের মনের মধ্যে কাজ করেছিল। এ সকল কারণে আগে থেকেই  পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যগণ মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পুলিশ লাইনের বাঙালী পুলিশ সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে পরিখা খনন করেন। কয়েকটি বাংকারও তৈরি করা হয়।

ভৌগোলিক অবস্থান

২৪ ডিগ্রী ০৭ মিনিট হতে ২৪ ডিগ্রী ৪৩ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮ ডিগ্রী ১৭ মিনিট হতে ৮৮ ডিগ্রী ৫৮ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। রাজশাহী জেলার দক্ষিণে ভারত, পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পূর্বে নাটোর এবং উত্তরে নওগাঁ জেলা। এই প্রতিবেশী জেলাগুলো পূর্বে এই জেলারই অন্তর্ভূক্ত ছিল। এখনো এই জেলাগুলোকে মিলিয়ে ‘বৃহত্তর রাজশাহী জেলা’বলা হয়ে থাকে।

জেলার নদ-নদী

পদ্মা, মাথাভাঙা, পুনর্ভবা, বারনই, রাণী, কম্পো নদী ইত্যাদি ।

উপজেলা সমূহ

• গোদাগাড়ী উপজেলা
• তানোর উপজেলা
• মোহনপুর উপজেলা
• বাগমারা উপজেলা
• দুর্গাপুর উপজেলা,
• বাঘা উপজেলা
• চারঘাট উপজেলা
• পবা উপজেলা
• পুঠিয়া উপজেলা

রাজশাহী জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ

• পুঠিয়া রাজবাড়ী, পুঠিয়া
• বাঘা মসজিদ, বাঘা
• বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর
• শহীদ এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা
• পদ্মা গার্ডেন
• কিসমত মারিয়া মসজিদ, দূর্গাপুর
• সাবাশ বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব

• চারু মজুমদার
• প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী
• শহীদ এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান রাজনীতিবিদ
• অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
• রাণী ভবানী
• মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবী
• হাসান আজিজুল হক (কথাসাহিত্যিক)
• সেলিনা হোসেন (কথাসাহিত্যিক)
• মাহিয়া মাহী (চিত্রনায়িকা)

• আনিকুল ইসলাম (ইঞ্জিনিয়ার)
• মোঃজিএম শাহ্ ( পশ্চিমবঙ্গ মুর্শিদাবাদ)
• ফজলে হোসেন বাদশাহ (সংসদ সদস্য)
• এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন (সিটি মেয়র)
• শাহরিয়ার আলম (বাঘা-চারঘাট উপজেলা), – রাজনীতিবিদ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
• আব্দুর রাজ্জাক- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল,বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
• ডা.শরিফ আহম্মেদ(হিরা)- কর্নেল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
• পলান সরকার (বাঘা উপজেলা), সমাজসেবী, সাদা মনের মানুষ।

• ড. আবুল হাসান, পরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ।
• আলহাজ্ব মো. নাসির উদ্দন সরকার, প্রতিষ্ঠাতা, নাসিরগন্জ ডিগ্রি কলেজ (১৯৯৫) এবং নাসিরগন্জ পোস্ট অফিস (১৯৬৮)।
• সরদার আমজাদ হোসেন সাবেক মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী, খাদ্য প্রতিমন্ত্রী, ভূমি মন্ত্রী দায়িত্বপ্রাপ্ত
• ড.জাহিদ দেওয়ান শামীম,সিনিয়র সাইন্টিস্ট,নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন
• যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী খাজা এম,এ মজিদ
• মিজানুর রহমান চঞ্চল, সহকারী পরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়; ঢাকা, বাংলাদেশ।

• বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জমির মন্ডল, দূর্গাপুর উপজেলার যুগিশো গ্রামের সন্তান।

তথ্যসূত্র: জাতীয় তথ্যবাতায়ন, উইকিপিডিয়া ।

আরও পড়ুন রংপুর জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

 

Leave a Reply

%d bloggers like this: