বাংলাদেশ ইতিহাস

বগুড়া জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

বগুড়া জেলার পরিচিতি ও ইতিহাসবগুড়া জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

বগুড়া

দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী ও উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত এক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন পুন্ড্র রাজ্যের রাজধানী পুন্ড্রবর্ধনই হচ্ছে বর্তমান বগুড়া জেলা। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন প্রভৃতি রাজাদের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল প্রাচীন জনপদ বগুড়া। রাজশাহী বিভাগ-এর অন্তর্গত এই জেলার সুদীর্ঘ ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিবেচনা করে জেলা ব্রান্ডিং হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে ঐতিহাসিক পুণ্ড্রনগর মহাস্থানগড়কে।

বগুড়া জেলার নামকরণের ইতিহাস

• বগুড়া নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে জানা যায় ১২৮১-১২৯০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লরি সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের ২য় পুত্র সুলতান নাসিরউদ্দীন বগরা খান বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তাঁর নামানুসারে বগুড়া জেলার নামকরণ করা হয়েছে। তার মানে, বগুড়া জেলার আরেকটি নাম হল “বগরা” । সুলতান নাসির উদ্দিন বগরা ১২৭৯ থেকে ১২৮২ পর্যন্ত বগুড়া অঞ্চলের শাসক ছিলেন।

• আরেকটি মত হল, বঙ্গদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের স্থানিক নাম ছিল ‘বগ্ড়ী’। সেটা রাজা বল্লাল সেনের আমল। সেই আমলে বঙ্গদেশকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। বঙ্গ, বরেন্দ্র, মিথিলা, বাঢ় ও বগ্ড়ী। শেষোক্ত ‘বগ্ড়ী’ অংশে নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী ‘বাগিদ’দের সংখ্যাগুরুত্ব ও অধিক শক্তিমত্তা ছিল। এই বাগদি শব্দটিই অপভ্রংশ ‘বগ্ড়ী’ রূপ ধারণ করতে পারে। কালে রূপান্তরিত এই ‘বগ্ড়ী’ই ‘বগুড়া‘ উচ্চারণে স্থির হয়েছে বলে একটি ধারণা রয়েছে। তবে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারণ বগুড়ার অবস্থান বঙ্গদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে নয়।

বগুড়া জেলার ইতিহাস

১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত উত্তর বঙ্গের এই অঞ্চলটি প্রশাসনিকভাবে রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল। এই তিনটি জেলাই ছিল আয়তনে বিশাল। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী জেলা থেকে আদমদিঘি শেরপুর নৌখিলা ও বগুড়া থানা, রংপুর জেলা থেকে দেওয়ানগঞ্জও গোবিন্দগঞ্জ থানা দিনাজপুর জেলা থেকে লালবাজার, ক্ষেতলাল ও বদলগাছি থানা নিয়ে বগুড়া জেলা গঠিত। এই সময় এই জেলার প্রশাসক হিসেবে জন্য একজন জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়।১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জেলার প্রায় অর্ধাংশের রাজস্ব সংগ্রহের জন্য এই জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা দেওয়া হয়।

১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী জেলার রায়গঞ্জথানা বগুড়া জেলার অধীনে আনা হয়। এই পদ্ধতিতে বগুড়ার রাজস্ব আদায় সুসম্পন্ন করায় ব্যাঘাতের সৃষ্টি হয়। তৎকালীন বগুড়ার পূর্ব-প্রান্তের ব্রহ্মপুত্র নদের পার্শ্ববর্তী ৮০ মাইলের ভিতরের সকল জমিদারের খাজনা বোয়ালিয়ার সরকারী কোষাগারে জমা হতো। আবার তৎকালীন বগুড়া শহর থেকে ১২ মাইল দূরের দাওকোবার রাজস্ব জমা হতো ময়মনসিংহের সরকারি কোষাগারে। জমিদারদের রাজস্ব জমার অসুবিধার জন্য, কিছুদিনের জন্য নিয়ম করা হয়েছিল যে, জমিদাররা, বোয়ালিয়া, বগুড়া ও ময়মনসিংহের যে কোনো রাজস্ব অফিসে তাদের রাজস্ব জমা দিতে পারবে।

এই নিয়ম প্রচিলত হওয়ার পর দেখা গেল, স্থানীয় অধিকাংশ জমিদার বগুড়া কোষাগারে রাজস্ব জমা দিচ্ছে। রাজস্ব আদায়ের এই বিষয়টি বিবেচনা করে, ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ময়মনিসংহ ও রাজশাহী জেলা থেকে ৫৪৯টি জমিদারি বগুড়া কালেক্টরের অধীনে আনা হয়। উল্লেখ্য এর আগে বগুড়ার অধীনে২৮৭টি জমিদারি ছিল। এরফলে বগুড়ার প্রশাসনিক আয়তন বৃদ্ধি পায়। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে দাওকোবা নদীর বিশাল আকার ধারণ করে।

এর ফলে রাজস্ব আদায়ে অসুবিধা সৃষ্টি হয়। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে এ বিষয়ে তদন্তের জন্য দেওয়ানি আদালেতর মিলস নামক একজন জজকে পাঠানো হয়। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি তারিখে তৎকালীন ভারত সরকারের আদেশ অনুযায়ী দাওকোবা নদী বগুড়া জেলার পূর্বসীমা নির্ধারিত হয়। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে বাউন্ডারি কমিশনারের নির্দেশানুসারে বগুড়া জেলার দক্ষিণ সীমানার কিছু অংশ রাজশাহী জেলার অন্তর্গত হয়। এই সময় ক্ষাদ্র ভাদাই বা ভাদ্রাবতী নদীকে বগুড়ার সীমানা নির্ধারিত। এই বৎসরের ১২ই আগষ্ট বগুড়ার গোবিন্দগঞ্জ থানাকে রংপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় ১০২টি গ্রামকে গোবিন্দগঞ্জ থানার অধীনে নেওয়া হয় এবং এই থানার ৯টি গ্রামকে বগুড়া থানায় রাখা হয়।

এছাড়া ৪৭টি গ্রামকে শিবগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই মার্চে লালবাজার থানাকে পাঁচবিবিতে স্থানান্তর করা হয়। ২০শে মার্চ মানাস নদী মজে যাওয়ায় কারণে নৌখিলা থানাকে সারিয়াকান্দির সাথে যুক্ত করা হয়। এরপর ৮ অক্টোবরে, বগুড়া জেলার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের রায়গঞ্জথানাকে পাবনা জেলার সীমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এক্ষেত্রে মধ্যবর্তী সীমানা হিসেবে ইছামিত নদীকে রাখা হয়।

১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বরে ৪৩৯টি গ্রাম ময়মনিসংহ জেলা থেকে নিয়ে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি থানার সাথে যুক্ত করা হয়। এই বৎসর শিবগঞ্জথানা বগুড়া থানার আউট পোষ্টে পরিগণিত হয়। ১৮টি নতুন গ্রাম যুক্ত হওয়ায় শিবগঞ্জথানাকে পূর্ণাঙ্গ থানায় পরিণত করা হয়। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জেলার একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং একজন কালেক্টরের শাসনাধীনে আনা হয়। এই নিয়োগের ফলে বগুড়া একটি পূর্ণাঙ্গ জেলায় পরিণত হয়।

বগুড়া জেলার ভৌগোলিক অবস্থান

৮৮.৫০ ডিগ্রী পূর্ব থেকে ৮৮.৯৫ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশে এবং ২৪.৩২ ডিগ্রী উত্তর থেকে ২৫.০৭ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশে বগুড়া সদর উপজেলা অবস্থিত। বগুড়া জেলার উত্তরে গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট জেলা, দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলা, পূর্বে জামালপুর জেলা ও যমুনা নদী এবং পশ্চিমে নওগাঁ জেলা অবস্থিত ।

বগুড়া জেলার উপজেলাসমূহ

বগুড়া জেলা ১৮২১ সালে জেলা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। জেলায় উপজেলার সংখ্যা মোট ১২ টি। পৌর সভার সংখ্যা ১২ টি, ইউনিয়ন রয়েছে মোট ১০৮ টি। এছাড়া জেলায় ২,৬৯৫ টি গ্রাম, ১,৭৫৯ টি মৌজা রয়েছে। বগুড়া জেলার উপজেলা গুলি হল –

• শাজাহানপুর উপজেলা
• আদমদিঘী উপজেলা
• বগুড়া সদর উপজেলা
• ধুনট উপজেলা
• দুপচাঁচিয়া উপজেলা
• গাবতলী উপজেলা
• কাহালু উপজেলা
• নন্দীগ্রাম উপজেলা
• সারিয়াকান্দি উপজেলা
• শেরপুর উপজেলা
• শিবগঞ্জ উপজেলা, বগুড়া
• সোনাতলা উপজেলা

বগুড়া জেলার নদ-নদীসমূহ

করতোয়া,বাঙ্গালী,যমুনা,নাগর,হলহলিয়া,ইছামতি,মহিষাবান,সুখদহ,ডাকুরিয়া,বেলাই,ভাদাই/ভদ্রাবতী,চন্দ্রবতী,গাংনই,গজারিয়া,মানস/মোনাস,বানিয়াইয়ান,ইরামতি,ভেলকা

বগুড়া জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ

১। মানকালীর কুন্ড ধাপ
২। বিহার ধাপ
৩। পরশুরামের প্রাসাদ
৪। বেহুলা লক্ষিণদ্বরের বাসর ঘর (গোকুল মেধ)
৫। খেরুয়া মসজিদ
৬। ভীমের জাঙ্গাল
৭। যোগীর ভবন
৮। ভাসু বিহার
৯। মহাস্থানগড়
১০। পাঁচপীর মাজার কাহালু

১১। সারিয়াকান্দির পানি বন্দর
১২। বাবুর পুকুরের গণকবর, শাজাহানপুর
১৩। জয়পীরের মাজার,দুপচাচিয়া
১৪। সান্তাহার সাইলো
১৫। দেওতা খানকাহ্ মাজার শরীফ,নন্দীগ্রাম
১৬। হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী মাহীসওয়ার (রহঃ) মাজার শরীফ
১৭। শীলাদেবীর ঘাট
১৮। জিউৎকুন্ড
১৯। মহাস্থান প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর
২০। গবিন্দ ভিটা

বগুড়া জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব

• জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম (১৯৩৫-১৯৮১) – স্বাধীনতাপত্র পাঠক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি
• প্রফুল্ল চাকী (১৮৮৮-১৯০৮) – ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলনের নেতা
• মোহাম্মদ আলী বগুড়া (মৃত্যুঃ ১৯৬৯) – কূটনীতিক এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
• খাদেমুল বাশার, বীর উত্তম (১৯৩৫-১৯৭৬) – মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং বিমান বাহিনীর সবেক প্রধান
• আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) – সাহিত্যিক ও গল্পকার
• গাজীউল হক (১৯২৯-২০০৯) – ভাষা সৈনিক
• এম. আর. আখতার মুকুল (১৯২৯-২০০৪) – লেখক এবং সাংবাদিক

• মনোজ দাশগুপ্ত (১৯৪৯-১৯৯৭) – কবি ও লেখক
• মুশফিকুর রহিম – বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট টেস্ট দলের সাবেক অধিনায়ক
• রোমেনা আফাজ – সাহিত্যিক
• শফিউল ইসলাম সুহাস – একজন বাংলাদেশী ক্রিকেটার
• এনামুল হক – (একুশে পদক ২০১৪, স্বাধীনতা পদক ২০১৭)
• অপু বিশ্বাস – একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী
• ফরিদুর রেজা সাগর – চ্যানেল আই চেয়ারম্যান।
• তারেক রহমান – বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি।
• মাহমুদুর রহমান মান্না – নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক

 

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, তথ্যবাতায়ন, পত্রিকা

আরও পড়ুন সিলেট জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

Leave a Reply

%d bloggers like this: