মাইগ্রেন এর ব্যাথা থেকে মুক্তি লাভ এর উপায়
মাইগ্রেন কি?
মাইগ্রেন অসহনীয় মাথা ব্যথার অপর নাম। আর দশটা মাথা ব্যথা থেকে ভিন্ন এই মাথা ব্যথা। সাধারণত মাইগ্রেনের ব্যথা মাথার একপাশ থেকে শুরু হলেও আস্তে আস্তে এটি সম্পূর্ণ মাথায় ছড়িয়ে যেতে থাকে।এতে মস্তিষ্কে স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়। মস্তিষ্কের বহিরাবরণে যে ধমনিগুলো আছে, সেগুলো মাথাব্যথার শুরুতে স্ফীত হয়ে যায়। মাথা ব্যথার সাথে আরও কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে মাইগ্রেনের সময়। ঘাড়সহ মাথা ব্যথা, আবছা দেখা, অস্বস্তিকর অনুভূতি, বমি বমি ভাব, শব্দ এবং উজ্জ্বল আলো, বিষন্নতা, অনিয়মিত ঘুম ইত্যাদি মাইগ্রেন এর অন্যতম লক্ষ্যণ।
মাইগ্রেনের স্থায়ী কোন সমাধান নেই। ব্যথা কমানোর জন্য সাধারণত ব্যথানাশক ঔষুধ বা পেইনকিলার খেয়ে থাকে। আবার অনেকে ঘরোয়া উপায়ে এই ব্যথা থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করে থাকে। সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সে মাইগ্রেন শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১১ শতাংশ বয়স্ক মানুষ মাইগ্রেনজনিত মাথাব্যথায় ভোগেন।
সব মাথাব্যথাই মাইগ্রেন নয়। দৃষ্টিস্বল্পতা, মস্তিষ্কের টিউমার, মাথায় অন্য সমস্যার কারণে মাথাব্যথা হতে পারে। মাইগ্রেন একধরনের প্রাইমারি হেডেক, যা নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব। চিকিৎসকের অধীনে এবং নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা করা উচিত। মাইগ্রেনের ব্যথা চোখের কোনো সমস্যার জন্য হয় না। মাইগ্রেন কোনো সাধারণ মাথা ব্যথা নয়, এটি এক ধরণের নিউরোলজিক্যাল সমস্যা।
মাইগ্রেনের প্রকারভেদ :
মাইগ্রেনকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যেমন : কমন মাইগ্রেন , ক্লাসিক্যাল মাইগ্রেন , অপথালমোপ্লেজিক মাইগ্রেন, ব্যাসিলার আর্টারি মাইগ্রেন, হেমিপ্লেজিক মাইগ্রেন ইত্যাদি।
কমন মাইগ্রেন : মাথাব্যথার সঙ্গে বমি বা বমিভাব কিন্তু কোনো প্রকার দৃষ্টি বিভ্রম বা চোখের সামনে আলোর ঝলকানি থাকে না।
ক্লাসিক্যাল মাইগ্রেন : প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর দৃষ্টিবিভ্রম হতে পারে। এমতাবস্থায় রোগী চোখের সামনে আলোর ঝলকানি ও চোখে শর্ষে ফুল দেখে। রোগীর হাত, পা, মুখের চারপাশে ঝিনঝিনে অনুভূতিসহ শরীরের এক পাশে দুর্বলতা ও অবশভাব হতে পারে। তারপর শুরু হয় মাথাব্যথা, যা মাথার এক পাশ থেকে শুরু হয়ে আস্তে আস্তে পুরো স্থানেই বিস্তৃত হয়। প্রচন্ড দপদপে ব্যথা, প্রচুর ঘাম বের হওয়াসহ বমি কিংবা বমি বমি ভাব রোগীকে কাহিল করে ফেলে।
মাইগ্রেন কেন এবং কাদের বেশি হয়?
এই সমস্যা কেন হয় তা পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে এটি বংশগত বা অজ্ঞাত কোনো কারণে মাইগ্রেন হতে পারে। মাইগ্রেন সাধারণত পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি হয়। নারীদের ঋতুস্রাবের সময় মাথাব্যথা বাড়ে। চকলেট, পনির, কফি ইত্যাদি বেশি খাওয়া, জন্মবিরতিকরণ ওষুধ, দুশ্চিন্তা, ভ্রমণ, ব্যায়াম, অনিদ্রা, অনেকক্ষণ টিভি দেখা, দীর্ঘসময় কম্পিউটারে কাজ করা, মোবাইলে কথা বলা ইত্যাদির কারণে এ রোগ হতে পারে। মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, কোষ্ঠকাঠিন্য, অতি উজ্জ্বল আলো মাইগ্রেন বাড়িয়ে দেয়।
মাইগ্রেন এর লক্ষণ
মাথাব্যথা শুরু হলে তা কয়েক ঘণ্টা, এমনকি কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। মাথাব্যথা, বমি ভাব এ রোগের প্রধান লক্ষণ। তবে অতিরিক্ত হাই তোলা, কোনো কাজে মনোযোগ নষ্ট হওয়া, বিরক্তিবোধ করা ইত্যাদি উপসর্গ মাথাব্যথা শুরুর আগেও হতে পারে। মাথার যেকোনো অংশ থেকে এ ব্যথা শুরু হয়। পরে পুরো মাথায় ছড়িয়ে পড়ে। চোখের পেছনে ব্যথার অনুভূতি তৈরি হতে পারে। শব্দ ও আলো ভালো লাগে না। কখনো কখনো অতিরিক্ত শব্দ ও আলোয় মাইগ্রেন এর ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।
যেসব খাবার মাইগ্রেনের সমস্যা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে
* ম্যাগনেশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার। যেমন ঢেঁকি ছাঁটা চালের ভাত, আলু ও বার্লি মাইগ্রেন প্রতিরোধক।
* বিভিন্ন ফল, বিশেষ করে খেজুর ও ডুমুর মাইগ্রেন এর ব্যথা উপশম করে।
* সবুজ, হলুদ ও কমলা রঙের শাকসবজি নিয়মিত খেলে মাইগ্রেন এর উপকার হয়।
* ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি মাইগ্রেন প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। তিল, আটা ও বিট ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম রয়েছে।
* আদার টুকরো বা রস দিনে দুবার জিঞ্চার পাউডার পানিতে মিশিয়ে খেতে পারেন।
মাইগ্রেন সমস্যায় কী ধরনের খাবার এড়িয়ে চলবেন
* চা, কফি ও কোমলপানীয়, চকলেট, আইসক্রিম, দই, দুধ, মাখন, টমেটো ও টক জাতীয় ফল খাবেন না
* গম জাতীয় খাবার, যেমন রুটি, পাস্তা, ব্রেড ইত্যাদি
* আপেল, কলা ও চিনাবাদাম
* পেঁয়াজ
তবে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন খাবারে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই সবচেয়ে ভালো হয় একটা ডায়েরি রাখা। যাতে আপনি নোট করে রাখতে পারেন কোন কোন খাবার ও কোন কোন পারিপার্শ্বিক ঘটনায় মাইগ্রেন এর ব্যথা বাড়ছে বা কমছে। এ রকম এক সপ্তাহ নোট করলে আপনি নিজেই নিজের সমাধান পেয়ে যাবেন। তবে ব্যথা বেশি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মাইগ্রেন থেকে রেহাই পাওয়ার কিছু উপায়
* মাইগ্রেন চিকিৎসায় তাৎক্ষণিক এবং প্রতিরোধক ওষুধের পাশাপাশি কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে সমস্যা অনেকাংশে কমে যায়।
* প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে হবে এবং সেটা হতে হবে পরিমিত।
* অতিরিক্ত বা কম আলোতে কাজ না করা।
* কড়া রোদ বা তীব্র ঠান্ডা পরিহার করতে হবে।
* উচ্চশব্দ ও কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে বেশিক্ষণ না থাকা।
* বেশি সময় ধরে কম্পিউটারের মনিটর ও টিভির সামনে না থাকা।
* মাইগ্রেন শুরু হয়ে গেলে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা (বিশেষ করে বমি হয়ে থাকলে), বিশ্রাম করা, ঠান্ডা কাপড় মাথায় জড়িয়ে রাখা উচিত।
মাইগ্রেন ব্যথা দূর করার সহজ এবং কার্যকরী একটি উপায় হল হিমালয় সল্ট বা বিট লবণ। বিট লবণ মাইগ্রেনের ব্যথা দূর করতে বেশ কার্যকরী। এর জন্য বেশি কিছু করার প্রয়োজন পড়বে না।
যা যা লাগবে:
- অর্ধেকটা লেবুর রস
- হিমালয় সল্ট বা বিট লবণ
যেভাবে তৈরি করবেন:
১। প্রথমে অর্ধেকটা লেবুর রস করে নিন।
২। এর সাথে এক টেবিল চামচ উচ্চ পরিবেশিত ঘনত্ব সম্পন্ন হিমালয় মিশিয়ে নিন।
৩। সাধারণত অর্ধেকটা লেবুর রসের সাথে হিমালয় সল্ট মেশানো হয়ে থাকে। তবে আপনি চাইলে একগ্লাস লেবুর রসের সাথে হিমালয় ক্রিস্টাল সল্ট মিশিয়ে নিতে পারেন।
মাইগ্রেনের ব্যথার সময় এই পানীয়টি খেতে পারেন।
যেভাবে কাজ করে:
হিমালয় সল্টে ৮৪টির মত মিনারেল, ইলেক্ট্রোলাইট উপাদান আছে, যার মাত্র ১১৮টি উপাদান বৈজ্ঞানিকরা আবিস্কার করতে পেরেছেন। হিমালয় সল্টের কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। যাদের অ্যাসিডিটি সমস্যা আছে তারা অর্ধেকটা লেবুর রসের সাথে হিমালয় সল্ট মিশিয়ে পান করুন। এই পানীয়টি আপনার মাইগ্রেনের ব্যথা কমিয়ে দেবার পাশাপাশি বমি বমি ভাবসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও দূর করে দিবে। এটি মাইগ্রেন এর ব্যথা হ্রাস করে আপনাকে কাজে শক্তি যুগিয়ে থাকে।
সতর্কতা: যাদের উচ্চ রক্তাচাপের সমস্যা আছে বা অন্য কোনো কারণে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া মানা, তারা অবশ্যই ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিন এই উপায়টি অনুসরণ করার আগে।
মাইগ্রেন থেকে ঘরোয়া কিছু টিপস
১. বরফ প্যাক
মাইগ্রেনের ব্যথা বেশি হলে একটি প্লাস্টিকে কিছু বরফের টুকরো নিয়ে মাথায় ব্যথা জায়গায় দিয়ে রাখতে পারেন৷ বরফ আপনার শিরার স্ফীতি কম করে৷ এতে মাথা ব্যথা কম হবে৷
২. ভিটামিন বি২
ভিটামিন বি২ এর পরিমাণ শরীরে বাড়লে মাইগ্রেনের ব্যথা কম হয়৷ ৪০০ এম জি ভিটামিন বি২-র ট্যাবলেট মাইগ্রেন কম করতে সাহায্য করে৷ এছাড়া মাছ, মাংস, ডিম, দুগ্ধজাত খাদ্য, চিজ, বাদাম, এসবে ভিটামিন বি২ এর পরিমাণ বেশি থাকে৷
৩. বিশ্রাম পদ্ধতি
মাইগ্রেনের ব্যথার প্রকোপ শুরু হলে আপনার মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিন৷ চিন্তা মুক্ত থাকুন৷ এর জন্য প্রয়োজনে মেডিকেশন, যোগ ব্যায়ামও করতে পারেন৷
৪. হার্বাল চা
হার্বাল চা মাইগ্রেন ব্যাথার পক্ষে খুবই উপকারী৷ হার্বাল চায়ে আঁদা কুচি, লেবু দেওয়া থাকে৷ এর ফলে ব্যথার প্রকোপ কম থাকে৷ আবার মাইগ্রেনের ফলে যে বমি ভাব তৈরি হয় তা কম করতেও সাহায্য করে এই উপাদানগুলি৷ বিশেষ করে আদা চা খুব উপকারী।
৫. গোলমরিচ
ঘরোয়া উপায়ে মাইগ্রেন থেকে রক্ষা পেতে গোলমরিচের বিকল্প নেই। এটি রক্ত প্রবাহ বাড়ায় এবং অনুভূতিতে প্রভাব ফেলায় দ্রত ব্যথা কমে যায়। এক কাপ গরম পানিতে আধা চা চামচ গোলমরিচ মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যাবে। এছাড়া সঙ্গে মধু ও লেবু মিশিয়ে নিয়ে আরো দ্রুত কাজ করবে।
৬. অ্যাপেল সিডার ভিনেগার
মাইগ্রেনের ব্যথা থেকে বাঁচতে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার খুবই কার্যকর। ১ গ্লাস পানিতে ২ চা চামচ আপেল সিডার ভিনেগার দিয়ে এতে ১ চা চামচ মধু এবং ১ চা চামচ লেবুর রস ভালো করে মিশিয়ে নিন। এই পানীয় মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হলে দিনে ২-৩ বার পান করুন। মাইগ্রেনের ব্যথা দূর হবে খুব দ্রুত।
৭. মেন্থল তেল
মেন্থলে প্রচুর ব্যথানাশক উপাদান রয়েছে যা মাইগ্রেনের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়। কয়েক ফোঁটা মেন্থল তেল হাতের তালুতে নিয়ে মাথা ও ঘাড়ের পেছনে আলতো করে ঘষে নিন। ব্যথার তীব্রতা কমবে।
৮. আকুপাংচার
মাইগ্রেন ব্যথা কমানোর জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হয় তার থেকে অনেক বেশি প্রভাশালী ও উপকারী হল আকুপাংচার পদ্ধতি৷ এর প্রভাপ ওষুধের মতো দ্রুত কার্যকরী হয় না৷ কিন্তু বেশিক্ষণ প্রভাবশালী হয়৷
ওষুধ : মাইগ্রেন চিকিৎসায় দুটো ধাপ রয়েছে- একটি এবোরটিব এবং অন্যটি প্রিভেনটিব।
যাদের বার বার ব্যথা হয় এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় তাদের জন্য প্রিভেনটিব চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। মনে রাখতে মাইগ্রেন একধরনের প্রাইমারি হেডেক, যা নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব। নিউরোলজিস্টের অধীনে এবং চেকআপের মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা করা উচিত।
তাই এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।