লাইফ স্টাইল ও টিপসস্বাস্থ্যহেলথ টিপস

পাইলস বা অর্শরোগের ঘরোয়া সমাধান

পাইলস বা অর্শরোগের ঘরোয়া সমাধানপাইলস বা অর্শরোগের ঘরোয়া সমাধান

পাইলস বা অর্শরোগ

পায়খানা করতে গেলে ব্যথা করে সাথে রক্ত যায়। পায়খানার রাস্তায় গোটা গোটা কী যেন হয়েছে! সমাধান কী? অনেক রোগী আছেন যারা দীর্ঘদিন এই রোগে ভোগার পরে আর না পেরে তবেই ডাক্তারের  কাছে যান। কারণ এই রোগটা নিয়ে কথা বলতে আমরা লজ্জা পাই, ডাক্তারের কাছে যেতে চাই না। তাই ক্রমশ রোগটা জটিল হতে থাকে। আজকের লেখাটি পাইলস নিয়ে যা বাংলায় অর্শ রোগ নামে পরিচিত । লেখাটি রোগটির কারণ ও সমাধান খুব সহজে বুঝিয়ে দিতে সাহায্য করবে।কী কারণে কী হচ্ছে সবকিছুই আপনি জানতে পারবেন।

পাইলস বা অর্শরোগ কী?

প্রথমে জানা যাক পায়ুপথে কী হয়। পায়ুপথ বলতে বোঝায় শরীর থেকে যে পথে পায়খানা বের হয়ে যায়। এই পায়ুপথের মুখ সাধারণত বন্ধ থাকে। আমাদের যখন প্রয়োজন হয় আমরা চাপ দিয়ে সেই পায়ুপথের মুখ খুলে শরীর থেকে পায়খানা বা মল বের করে দিই। পায়ুপথের মুখ বন্ধ রাখতে সেখানে বেশকিছু জিনিস এক সাথে কাজ করে। তার মধ্যে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নাম হলো এনালকুশেন। এগুলো তিন দিক থেকে চাপ দিয়ে পায়ুপথের মুখ বন্ধ রাখতে সাহায্য করে। যদি কোন কারণে তিন দিকের এই কুশন গুলো ফুলে যায়, সেগুলো থেকে রক্ত ক্ষরণ হয় বা সেগুলো নিচের দিকে নেমে যায়, পায়ুপথের চারপশে গোটার মতো দেখা যায় তখন সেগুলোকে আমরা পাইলস বা অর্শ নামে চিনি। মেডিক্যালের ভাষায় নাম হলো হেমোরয়েডস।

রোগটি আপনার শরীরে যেসব প্রভাব ফেলতে পারেঃ

১। পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে। উজ্জ্বল লাল রঙের রক্ত। সাধারণত টয়লেট পেপার ব্যবহারের পর দেখা যায় সেখানে রক্তের ফোঁটা লেগে আছে অথবা কমোড বা প্যানের গায়ে দেখা যায় লাল রক্তের ছোপ। এখন প্রশ্ন হলো উজ্জ্বল লাল রক্ত কেন বের হয়? পায়খানা বের হওয়ার পথে একদম শেষ প্রান্তে রাস্তার মুখের কুশনগুলো থেকে রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। সেই রক্ত এখনও তাজা জমাট বাধার সময় পায়নি। তাই উজ্জ্বল লাল দেখা যায়। পক্ষান্তরে রক্তক্ষরণ যদি আরও আগেই হতো- ধরুন পাকস্থলীতেই রক্তরক্ষণ হয়েছে। তারপর সেই রক্ত নাড়ীভুড়ি দিয়ে আসতে আসতে জমাট বাধে, জমে পায়খানার সাথে মিশে যায় তখন পায়খানার রং হয় আলকাতরার মতো কালো। এমন হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। কারণ পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন কী হয়েছে।

২। কুশনগুলো ফুলে পায়ুপথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। তখন নরম গোটার মতো মনে হয়। সেগুলো সাধারণত মল ত্যাগের পরে বের হয়ে আসে। আর নিজে নিজে ভিতরে ঢুকে যায় বা আঙুল দিয়েও ভিতরে ঢুকাতে হতে পারে। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে পাইলস এমন পর্যায়ে পৌছে যায় যে আঙুল দিয়েও আর ভিতরে ঢুকানো যায় না।

৩। অনেকেই দুঃচিন্তা করেন পাইলস রোগে ব্যথা কেমন হয়। সাধারণত তীব্র ব্যথা হয় না তবে কখনও কখনও তীব্র ব্যথা হতে পারে। যেমন- পায়ুপথের বাইরে নরম গোটা থাকে, আঙুল দিয়ে ভিতরে ঢুকানো না যায় আর সেগুলোতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তখন তীব্র ব্যথা হয়। সাধারণত এই তীব্র ব্যথা এক থেকে দুই দিনের জন্য হয়। তীব্র ব্যথা হলে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। যদি শীঘ্রই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সুযোগ না থাকে তাহলে কিভাবে ব্যথা কমাবেন সেটা নিয়ে একটু পরেই বলছি। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি এই কাজগুলো করতে পারবেন।

৪। পাইলস হলে এগুলোছাড়াও পায়ু পথে চুলকাতে পারে, পায়ু পথ দিয়ে পিচ্ছিল কিছু পদার্থ বের হতে পারে। যেটা দেখতে শ্লেষমার মতো। মল ত্যাগ করার পরেও মনে হতে পারে পেট পরিষ্কার হয়নি, আবারও মল ত্যাগ করতে হবে।

পাইলস রোগের ওষুধ আর ঘরোয়া চিকিৎসাঃ

পাইলস এর চিকিৎসার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা। এজন্য একটা ভালো ওষুধ হচ্ছে ইসুবগুলের ভুষি। আমরা সবাই এই ওষুধ কমবেশি চিনি। তবে সঠিক ব্যবহার ও সাবধানতা অনেকের অজানা। তাই ইসুবগুলের ভুষি কখন খাবেন, কিভাবে খাবেন আর কখন খাওয়া উচিত না এই বিষয়ে অল্প সংক্ষেপে জানা যাক। প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশনা অনুযায়ী পরিমাণ মত পানি নিয়ে তাতে ইসুবগুলের ভুষি ভালো করে গুলিয়ে নিবেন যাতে শরবতটি দেখতে পরিস্কার বা হালকা ঘোলা দেখায়। বানানোর পর রেখে দেবেন না সাথে সাথে খেয়ে ফেলবেন।

অনেক রোগীই শরবতটি গুলিয়ে রেখে দেন এটা কিন্তু সঠিক ব্যবহার নয়। সাধারণত দিনে দুই বেলা খেতে হয়। খাবার খাওয়ার পরে খেলে সব চেয়ে ভালো। ইসুবগুলের ভুষি খেলে দিনে অন্তত ২ লিটার করে পানি পান করবেন। অল্প কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় ইসুবগুলের ভুষি খেয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি না খাওয়ার ফলে গলঃনালী এবং অন্ত্রের মুখ আটকে যায়। আপনি অবশ্যই এই ঝুঁকি নিতে চাইবেন না?

কখন ইসুবগুলের ভুষি খাওয়া যাবে না?

১। রাতে ঘুমানোর ঠিক আগে খাবেন না। তাতে আপনার বৃহদন্ত্র অর্থাৎ শরীরে যেখান থেকে মল তৈরি হয় সে জায়গার মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলে অবস্ট্রাকশান। এটা একটা ইমারজেন্সি অবস্থা। এমনটা হলে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে যেতে হয়। আপনার আগে যদি এমনটা হয়ে থাকে তাহলে আপনি ইসুবগুলের ভুষি খাবেন না।

২। যদি বমি বমি ভাব বা বমি হয় এবং পেটে যদি ব্যথা হয় ।

৩। আগে ইসুবগুলের ভুষি খাওয়ার পরে আপনার শরীরে যদি বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে।

৪। যদি দীর্ঘদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যের ফলে পায়ুপথের মুখে পায়খানা আটকে গেছে এমন হয়।

৫। যদি আপনার পায়খানা বা মল ত্যাগের অভ্যাসে হঠাৎ পরিবর্তন হয় এবং সেটা ২ সপ্তাহের বেশি থাকে।

৬। আগে থেকেই পায়ুপথ দিয়ে রক্ত যায় সেটার কারণ এখনও জানা যায় নি।

৭। যদি কলোনিক অ্যাটনি বা বৃহদন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল বা ধীর গতির এমন রোগে ভুগেন।

ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে অনেকদিন একটানা ইসুবগুলের ভুষি খাবেন না। এটা কিন্তু একটা ওষুধ। ডায়রিয়াসহ এর আরো কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। ৩ দিন ব্যবহারের ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যের কোন উন্নতি না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।

এবার আসছি ব্যথার ওষুধ প্রসঙ্গে। ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল খেতে পারেন। আরও অনেক ধরনের ওষুধ আর মলম আছে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন।

পাইলস হলেই কিছু কিছু ব্যথা নাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না। সেগুলো কী কী?

১। ট্রামাডল (Tramadol); কারণ এই ওষুধটার একটা কমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কোষ্ঠকাঠিন্য। বাজারে প্যারাসিটামলের সাথে ট্রামাডল মেশানো ওষুধ পাওয়া যায় এগুলো পাইলস রোগের ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলতে হবে।

২। আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen); যদি আপনার পাইলস থেকে রক্ত যায়। কারণ এই ওষুধটা রক্ত ক্ষরণের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

 

 

অর্শরোগের ঘরোয়া চিকিৎসার উপায়ঃ

বাসায় বসে বসে ওষুধের পাশাপাশি আর কিভাবে নিজের চিকিৎসা করতে পারেন এবং ব্যথা কমাতে পারেন তার ১০ টি উপায়-

১। ব্যথার জায়গাটা কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখতে পারেন। ছোট বাচ্চাদের গোসল করায় এমন একটা বোলে কুসুম গরম পানি নিয়ে সেখানটাতে বসতে পারেন। সদ্য যারা মা হয়েছেন তাদের পাইলস এর সমস্যা থাকলে দেখা যায় বাচ্চা হওয়ার পরে প্রথম কয়েকদিন সমস্যা বেড়ে যায়। তাদের জন্যও এই কুসুম গরম পানি ব্যবহারের একই পরামর্শ। তারা এটি দিনে ৩ বার পর্যন্ত করতে পারেন। এছাড়াও মায়েরা কোথাও বসার সময় সেখানে একটা বালিশ ব্যবহার করে ওটার উপর বসতে পারেন।

২। একটা প্যাকেটে কিছু বরফ নিয়ে তোয়ালে দিয়ে পেচিয়ে পায়ুপথের গোটাগুলোর উপর লাগাতে পারেন।

৩। বিছানায় শুয়ে পা উঁচু করে রাখতে পারেন। তাহলে গোটাগুলোতে রক্ত চলাচল সহজ হবে। পায়ের নিচে বালিশ দিতে পারেন। খাটের পায়ার নিচে কোন কিছু দিয়ে এক পাশ উঁচু করে সেদিকে পা দিতে পারেন।

৪। পায়ুপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর শুষ্ক রাখবেন। মল ত্যাগ করার পর খুব জোর দিয়ে মুছতে যাবেন না। টয়লেট পেপার হালকা ভিজিয়ে তারপর সেটা দিয়ে মুছতে পারেন।

৫। মল ত্যাগ করার সময় খুব জোরে চাপ দেওয়া যাবে না।

৬। অনেক লম্বা সময় ধরে মল ত্যাগ করবেন না। টয়লেটে বসে বসে মোবাইল চালানো, বই পড়া বা অন্য কাজ করাতে মনোনিবেশ করবেন না। মোট কথা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় টয়লেটে বসে থাকবেন না।

৭। পায়খানার চাপ আসলে সেটা আটকে রাখবেন না। পায়খানা আটকে রাখলে দিন দিন সেটা থেকে পানি শুকিয়ে শক্ত হতে থাকে। তাই চাপ আসলে দেরি না করে বাথরুমে চলে যাবেন।

৮। কোষ্ঠকাঠিন্য এড়িয়ে চলতে খাদ্যে যথেষ্ট পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ নিশ্চিত করবেন। এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করবেন। এই দুটো কাজ করলে সাধারণত কয়েকদিনের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাইলসের লক্ষণগুলোর উপশম হয়। ছয় সপ্তাহ অর্থাৎ দেড় মাস ধরে খাবারে পর্যাপ্ত ফাইবার নিশ্চিত করা যায় তাহলে ৯৫ শতাংশ পাইলস রোগীর পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া কমে আসে।

৯। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করবেন। ভারী ব্যায়াম বা প্রতিদিন দৌড়াতে হবে এমন না। শরীরকে চলমান রাখতে হবে। সেটা হাঁটাচলা, হালকা স্ট্রেচিং, যোগব্যায়াম ইত্যাদির মাধ্যমে হতে হবে। আপনি অল্প অল্প করে শুরু করতে পারেন। দিনে বিশ মিনিট হাঁটেন। এক বেলা দিয়ে শুরু করেন। তারপর দিনে দুই বেলা সকালে আর সন্ধ্যায় হাঁটেন। শুরু করেন সপ্তাহে তিন দিন। এমন করে আস্তে আস্তে সপ্তাহে ৫ দিনে আনেন। গবেষণায় দেখা গেছে এতটুকু হাঁটলেই সেটা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে কার্যকরী।

১০। ওজন অতিরিক্ত হলে সেটা কমিয়ে ফেলুন।

 কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে?

১। যদি ৭ দিন বাসায় চিকিৎসা করেও পাইলসের কোন উন্নতি না দেখেন।

২। যদি বারবার পাইলস হতে থাকে।

৩। বয়স যদি ৫৫ এর বেশি হয় এবং প্রথমবারের মতো পাইলস দেখা দেয়।

কখন দ্রুত হাসপাতালে যাবেন?

১। যদি পাইলস হতে পুঁজ বের হতে থাকে।

২। যদি গায়ে খুব জ্বর আসে কাঁপুনি হয় বা খুব অস্বস্তি লাগে।

৩। যদি অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে।

৪। যদি অনেক বেশি রক্ত যায়। কমোডের পানি লাল হয়ে গেছে বা বড় বড় রক্তের চাকা যাচ্ছে।

৫। যদি খুব তীব্র ব্যথা হয়।

৬। যদি পায়খানা আলকাতরার মতো কালো হয়।

 

তথ্যসূত্রঃ ডা. তাসনিম জারা, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এভিডেন্স মেডিসিন বিষয়ে অধ্যয়নরত

 

আরও জানতে পড়ুনঃ হাই ব্লাড প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ঘরোয়া উপায়

 

Leave a Reply

%d bloggers like this: