ব্রেইল;
পৃথিবীর অন্ধ মানুষদের লেখা পড়তে পারার এক অনন্য সমাধান এই ব্রেইল পদ্ধতি! অন্ধ হয়ে জন্ম নেওয়া বা জন্মের পরে যেকোনো কারণে বা দুর্ঘটনায় পড়ে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলার যে কি কষ্ট কেবল মাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউই অনুধাবন করতে পারে না। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকার নয়, চোখে দেখতে না পারার পরও আজকাল অনেকেই দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে। পড়ছে, শিক্ষকতা করছে বা অন্যান্য কাজে নিজেদের জড়াচ্ছে ।
কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব হচ্ছে? চোখে দেখতে না পাওয়ার পরেও কিভাবে একজন শিক্ষার্থী তার পাঠদান সম্পূর্ণ করছে?
ব্রেইল এই পদ্ধতি প্রচলন হওয়ার পর বিশ্বের অন্ধ মানুষদের কাছে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। অন্ধ মানুষেরা নিজে নিজে পড়াশোনা করার, জানার স্বাধীনতা লাভ করে। তাই ব্রেইল পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য জাতিসংঘ (United Nations) লুই ব্রেইলের জন্মদিন জানুয়ারি ৪ দিনটিকে বিশ্ব ব্রেইল দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব রাখে। ২০১৯ সাল থেকে এই দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে।
ব্রেইল পদ্ধতি কী?
ব্রেইল পদ্ধতি কাগজের ওপর ছয়টি বিন্দুকে ফুটিয়ে তুলে লিখবার একটি পদ্ধতি। দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা উন্নীত বা উত্তল ফুটিয়ে তোলা বিন্দুগুলোর ওপর আঙ্গুল বুলিয়ে ছয়টি বিন্দুর নকশা অনুযায়ী কোনটি কোন অক্ষর তা’ অনুধাবন করতে সক্ষম হয় এবং লেখার অর্থ বুঝতে পারে। ছয়টি বিন্দুর কোনোটিকে উন্নত করে আর কোনোটিকে উন্নত না-করে ৬৩টি নকশা তৈরী করা যায়। এক-একটি নকশা দিয়ে এক-একটি অক্ষর, সংখ্যা বা যতিচিহ্ন বোঝানো হয়। ৬টি বিন্দু বাম ও ডান দুটি উল্লম্ব স্তম্ভে সজ্জিত থাকে।
অর্থাৎ প্রতি আনুভূমিক সরিতে থাকে দুটি বিন্দু। বিন্দুগুলোর পরস্পরের আকার ও অন্তর্তী দূরত্ব থাকে অভিন্ন। যেমন, যদি কেবল বাম স্তম্ভের ওপরের বিন্দুটি উত্তল থাকে আর বাকী ৫টি থাকে সমতল, তবে এ নকশাটি দ্বারা ইংরেজি বর্ণমালার a অক্ষর বোঝায়। রন্ধ্রযুুক্ত ধাতব পাত ব্যবহার করের সাহায্যে হাতে বিশেষ ধরনের কাগজের ওপর ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা যায়। বিকল্পে একটি বিশেষায়িত টাইপরাইটার ব্যবহার করা হয়।
ব্রেইল পদ্ধতিতে একটি চতুর্ভুজ আকৃতির বক্স এ ছয়টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকবে ৩ x২ কলামে।অর্থাৎ নিচের দিকে তিনটি এবং পাশাপাশি ২ টি। প্রতিটি ছিদ্র এক একটি বর্ণমালা, সংখ্যা নির্দেশ করবে। এই ছয়টি খালি ছিদ্রের মধ্যে একটু উঁচু বা পূর্ণ যেগুলো থাকবে সেগুলোই হচ্ছে বর্নমালা বা সংখ্যা চেনার নির্দেশক।
এই পদ্ধতির মোট তিনটি ভার্সন বা শ্রেনীবিভাগ আছে। সেগুলো হলোঃ
গ্রেড ১: এটি মুলত যারা নতুন করে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়া শিখতে চায় তাদের জন্য। এই গ্রেডে সাধারণত ২৬ টি বর্নমালা এবং কিছু চিহ্ন শেখানো হয়।
গ্রেড ২: এই গ্রেডে বর্নমালা শেখানোর পাশাপাশি পাবলিক প্লেসে ব্যবহার করা বিভিন্ন চিহ্ন, ব্রেইলে করা বই পড়া, ব্রেইল করার জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্রের সাথে পরিচয় এবং তা ব্যবহার করার নিয়ম শেখানো হয়।
গ্রেড ৩: ব্রেইলের বর্ণমালা এবং পড়ার সাথে যারা মোটামুটি ভালভাবে পরিচিত হয় তাদের এই গ্রেডে বিভিন্ন ছোটখাটো লেখা কিভাবে লিখতে হয় সেটি শেখানো হয়।
ব্রেইলপদ্ধতির আবিষ্কার
ব্রেইল কোনো ভাষা নয়। এটি একটি লিখবার পদ্ধতি। দৃষ্টিহীনদের লেখা-পড়ার স্বার্থে যে ব্যক্তি এ পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছিলেন তার নাম লুই ব্রেইল (Louis Braille)। তার জন্ম ১৮০৯ সালে। তিনি ছিলেন একজন ফরাসি শিক্ষাবিদ। দৃষ্টিহীন এই ফরাসী বালক মাত্র পনের বৎসর বয়সে লেখার ও সহজে পাঠযোগ্য এই পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছিলেন। চার্লস বারবিয়ে কর্তৃক উদ্ভাবিত যুদ্ধকালীন সময়ে রাত্রিবেলায় পড়ার জন্য যে উত্তল অক্ষরের প্রচলন ছিল তা পর্যবেক্ষণ করে লুই ব্রেইল কাগজে উত্তল বিন্দু ফুটিয়ে লেখার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। তার নামেই এই পদ্ধতি পরিচিত। পরবর্তীতে ১৮২৯ সালে তিনি স্বরলিপি পদ্ধতিতেও প্রকাশ করেন। ১৮৩৭ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণটি ছিল আধুনিক যুগে বিকশিত প্রথম ক্ষুদ্র বাইনারি লিখন পদ্ধতি।
জীবনের কঠিনতম অগ্নিপরীক্ষায় যাঁরা দৃঢ়ভাবে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন তাঁদেরই জীবন পরিণত হয় মহাজীবনে। এই মহাজীবন কেবল দৃষ্টিহীনদের চোখকেই আলোকিত করেনি দৃষ্টিবানদেরও জীবনে জ্যোতি প্রদান করেছে।
তথ্যসূত্র: ব্রেইলওয়ার্কস.কম, উইকিপিডিয়া