বাংলাদেশ ইতিহাস

বাগেরহাট জেলার পরিচিতি , সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও দর্শনীয় স্থানসমূহ

বাগেরহাট জেলা aloasbei.comবাগেরহাট জেলা aloasbei.com

বাগেরহাট

বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জেলা। ইউনেসকো ঘোষিত বাংলাদেশে যে তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান রয়েছে, তার দুটির গর্বিত অবস্থান এই বাগেরহাট জেলায়। এর একটি হচ্ছে -ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদসহ খানজাহান (রহ:) এর কীর্তি, অন্যটি প্রকৃতির অপার বিষ্ময় সুন্দরবন।

বাগেরহাট জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাগেরহাটের নাম কে করে দিয়েছিলেন তা গবেষণা সাপেক্ষ হলেও আজ তা নিরূপন করা দুঃসাধ্য। কারো কারো মতে

ক) বাগেরহাটের নিকটবর্তী সুন্দরবন থাকায় এলাকাটিতে বাঘের উপদ্রব ছিল, এ জন্যে এই এলাকার নাম হয়ত ‘‘বাঘেরহাট’’ হয়েছিল এবং ক্রমান্বয়ে তা বাগেরহাট-এ রূপান্তরিত হয়েছে।

খ) হযরত খানজাহান (রঃ) এর প্রতিষ্ঠিত ‘‘খলিফাত-ই-আবাদ’’ এর বিখ্যাত ‘‘বাগ’’ অর্থ বাগান, এই অঞ্চলে এতই সমৃদ্ধি লাভ করে যে, তা থেকেই হয়ে দাঁড়িয়েছে বাগের আবাদ তথা ‘‘বাগেরহাট’’ ।

গ) সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হচ্ছে শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদীর উত্তর দিকের হাড়িখালী থেকে বর্তমান নাগের বাজার পর্যন্ত যে লম্বা বাঁক অবস্থিত, পূর্বে সে বাঁকের পুরাতন বাজার এলাকায় একটি হাট বসত। আর এ হাটের নামে এ স্থানটির নাম হলো বাঁকেরহাট। কালক্রমে বাঁকেরহাট পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে বাগেরহাট নামে।

বাগেরহাট জেলার ইতিহাস

বাগেরহাটে প্রথম বসতি স্থাপন করে অনার্য শ্রেণীর মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছে ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চল হতে আসা অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলীয় আলপাইন প্রভৃতি। এ অঞ্চলে অনার্য প্রভাবের বড় নিদর্শন হল পৌন্ড্রক্ষত্রিয় সম্প্রদায়। এ জেলার বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে রামপাল উপজেলায় এ সম্প্রদায়ের লোক বেশি বাস করে। পৌন্ড্র শব্দের অপভ্রংশ পুড়া বা পোদ। পৌন্ড্র শব্দটি দ্রাবিড় শব্দজাত যার অর্থ ইক্ষু। অনার্য শ্রেণীভুক্ত নম:শূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষও বাগেরহাটে প্রচুর বাস করে। এদের পূর্ব নাম চন্ডাল। এরা বরেন্দ্র অঞ্চল হতে এসে এখানে বসবাস শুরু করে। এছাড়া বাগেরহাটে এক শ্রেণীর মৎস্য শিকারী বা জেলে বসবাস করে যাদের আদি পুরুষ নিগ্রোবটু(নিগ্রয়েড) । এরা ভারত উপমহাদেশের আদিমতম অধিবাসী।

খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া হতে এ অঞ্চলে আর্য তথা আদি নর্কিভ বা ইন্ডিভদের আগমন ঘটে। আর্য-অনার্যের শোণিত ধারাই এ অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে ।বস্ত্ত পূজারী অনার্যগণ কৌমধর্ম (টাইবাল ধর্ম) অনুসরণ করতো। শক্তি পূজারী আর্যরা নিয়ে আসে বৈদিক ধর্ম। সূর্য ও অগ্নি ছিল তাদের অন্যতম উপাস্য। আর্য ও অনার্য উভয় ধর্মের আচার অনুষ্ঠান রীতিনীতির মিশ্রণে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দুধর্ম। বাগেরহাটের অতি প্রাচীন স্থান পানিঘাটে প্রাপ্ত কষ্টি পাথরের অষ্টাদশ ভূজা দেবীমূর্তি, মরগা খালের তীরে খানজাহান আলী এর পাথর ভর্তি জাহাজ ভিড়বার স্থান জাহাজঘাটায় মাটিতে গ্রোথিত পাথরে উৎকীর্ণ অষ্টাদশ ভূজা মহিষ মর্দিনী দেবীমূর্তি, চিতলমারী উপজেলাধীন খরমখালি গ্রামে প্রাপ্ত কৃষ্ণ প্রস্তরের বিষ্ণু মূর্তি ইত্যাদি নিদর্শন এখানে হিন্দু সভ্যতা বিকাশের পরিচয় বহন করে।

বাগেরহাট খুব পুরনো ভূখন্ড না হলেও বাগেরহাটের সমৃদ্ধির ইতিহাস উপমহাদেশের বহু প্রাচীন জনপদের সমকালীন ও সমপর্যায়ের। হযরত খানজাহান (রঃ) এর সময় এ অঞ্চলের দীঘি খননকালে বিশেষ করে ‘‘খাঞ্জেলী দীঘি’’ খননকালে পাওয়া ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি থেকে অনুমিত হয় হযরত খানজাহান (রঃ) এর আগমনের বহুপূর্ব হতেই বাগেরহাটে এক বিস্তীর্ণ জনপদ ছিল। বর্তমানে সেই বুদ্ধমূর্তি বাগেরহাটের শিববাড়ি থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ঢাকার কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারে রক্ষিত আছে।

বাংলার শাসক যখন নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৪২-১৪৫৯) তখন হযরত খানজাহান(রঃ) এ অঞ্চল আবাদ করে নামকরণ করলেন ‘‘ খলিফাত-ই-আবাদ’’ বা প্রতিনিধির অঞ্চল। মানুষের কল্যাণে তিনি তৈরী করলেন ষাটগম্বুজসহ অসংখ্য মসজিদ, দীঘি, রাসত্মা ও পত্তন করলেন অগণিত হাট-বাজার। হযরত খানজাহান(রঃ) এর আগমনকাল না জানা গেলেও এ সাধক পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বহু ধর্মপ্রাণ অনুসারিদের সাথে নিয়ে যশোর জেলার বার বাজার হয়ে ভৈরব নদী অতিক্রম করে বাগেরহাট পৌঁছান। তাঁর মাজারগাত্রে উৎকীর্ণ শীলালিপি হতে জানা যায় ২৬ জিলহজ্ব ৮৬৩ হিজরী(১৪৫৯ খ্রিঃ) তে তিনি ইন্তেকাল করেন।

হযরত খানজাহান(রঃ) এর তিরোধানের পর হুসাইন শাহীর বংশধরেরা এ অঞ্চল শাসন করতেন। বঙ্গেশ্বর নসরৎ শাহের খলিফাতাবাদ টাকশাল সম্ভবত বাগেরহাট শহরের মিঠাপুকুরের নিকটে অবস্থিত ছিল। মিঠাপুকুর পাড়ে সে আমলের একটি মসজিদ আছে। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের সময়ে নির্মিত এক আকর্ষণীয় মঠ যাত্রাপুরের অযোধ্যায়(কোদলা) অবস্থিত। আজকের বাগেরহাট সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা বাগেরহাট বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও সুন্দরবন অঞ্চলে দূর্ভেদ্য ঘাঁটি এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসন আমলে যশোরকে জেলায় পরিণত করা হয়। ১৮৪২ সালে খুলনা যখন যশোর জেলার একটি মহকুমা তখন বাগেরহাট খুলনার অন্তর্ভুক্ত একটি থানা।

১৮৪৯ সালে মোড়েল উপাধিধারী দু’জন ইংরেজ বাগেরহাটে মোড়েলগঞ্জ নামক একটি বন্দর স্থাপন করেন। ১৮৬১ সালের ২৬ নভেম্বর ‘‘মোড়েল-রহিমুলস্নাহ’’ নামে খ্যাত এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, তখন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সেই সংঘর্ষের তদন্ত তিনিই করেন এবং প্রশাসনিক প্রয়োজনে বাগেরহাটে একটি মহকুমা স্থাপন করার সুপারিশ করেন। ফলশ্রুতিতে ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট মহকুমা হিসেবে যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৮২ সালে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট মহকুমা নিয়ে খুলনা জেলা গঠিত হয়। ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়। বর্তমানে বাগেরহাট ০৯টি উপজেলা,৭৫টি ইউনিয়ন, ১০৪৭ টি গ্রাম এবং ০৩ টি পৌরসভার সমন্বয়ে গঠিত একটি “এ’’ ক্যাটাগরীভুক্ত জেলা।

ভৌগোলিক পরিচিতি

বাগেরহাট জেলার উত্তরে গোপালগঞ্জ ও নড়াইল জেলা, পশ্চিমে খুলনা জেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে পিরোজপুর জেলা ও বরগুনা জেলা। ২২ডিগ্রী ৩২মিনিট থেকে ২২ ডিগ্রী ৫৬ মিনিট উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৯ ডিগ্রী ৩২ মিনিট থেকে ৮৯ ডিগ্রী ৪৮ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশের জনপদের নামই বাগেরহাট। এ জেলার আয়তন ৫৮৮২.১৮ বর্গকিলোমিটার। তন্মধ্যে ১৮৩৪.৭৪ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল, ৪০৫.৩ বর্গকিলোমিটার জলাশয় এবং অবশিষ্টাংশ নিমণ সমভূমি। বাগেরহাট জেলা সদরের অধিকাংশ ভৈরব নদীর পশ্চিম তীরে এবং শহরের বর্ধিত অংশ ভৈরবের দক্ষিণ প্রবাহ দড়াটানার পশ্চিম তীরে অবস্থিত।প্রাকৃতিক প্রভাব ও ভৌগোলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে উপকূলীয় এলাকা দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন তীরবর্তী এবং অন্তবর্তী উপকূলীয় এলাকা।

জেলার নদ-নদী

দড়াটানা, পানগুছি, মধুমতি, পশুর, হরিণঘাটা, মোংলা, বলেশ্বর, ভাংগ্রা, গোসাইরখালী ইত্যাদি নদীসমূহ বাগেরহাটকে করেছে নদী-বিধৌত।

প্রশাসনিক এলাকাসমূহ

বাগেরহাট জেলা ৯ টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। উপজেলাগুলি হচ্ছে মোল্লাহাট, চিতলমারী, ফকিরহাট, কচুয়া, বাগেরহাট সদর, রামপাল, মংলা, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা।

বাগেরহাট জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ

প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা

• ষাট গম্বুজ মসজিদ
• খান জাহানের সমাধি
• কোদলা মঠ
• রেজা খোদা মসজিদ
• জিন্দা পীর মসজিদ
• ঠান্ডা পীর মসজিদ
• সিংগাইর মসজিদ

• বিবি বেগনী মসজিদ
• চুনাখোলা মসজিদ
• নয়গম্বুজ মসজিদ
• সিংগার মসজিদ
• এক গম্বুজ জামে মসজিদ, বাগেরহাট
• পীর আলীর সমাধি
• মুনিগঞ্জ শিবমন্দির, বাগেরহাট।
• শ্রী শ্রী গঞ্জেশ্বরী কালী মন্দির, বাগেরহাট।

• রণবিজয়পুর মসজিদ
• দশ গম্বুজ মসজিদ
• কুটিবাড়ি,জমিদারবাড়ি,মোড়েলগঞ্জ।
• বড় আজিনা
• ছয় গুম্বজ মসজিদ, বৈটপুর
• খান জাহানের নির্মিত প্রাচীন রাস্তা
• বড়বাড়িয়া মুন্সীবাড়ি প্রাচীন মসজিদ,চিতলমারী,বাগেরহাট

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

• সুন্দরবন                                                                                                                                                                             • ঢাংমারী বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য
• মাঝের চর, শরণখোলা
• চাঁদপাই বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য
• দুধমুখী বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য
• সুন্দরবন পূর্ব বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য
• দুবলার চর
• কটকা সমুদ্র সৈকত
• টাইগার পয়েন্ট

দীঘি/ জলাশয়

• ঘোড়া দীঘি
• খানজাহান আলীর দীঘি
• পচা দীঘি
• কোদাল ধোয়া দীঘি

অন্যান্য
• মংলা বন্দর
• খান জাহান আলী বিমানবন্দর
• সুন্দরবন রিসোর্ট, বারাকপুর
• চন্দ্রমহল, রনজিতপুর।
• বাগেরহাট জাদ
• ওয়ান্ডার কিংডম

• বাগেরহাট পৌর পার্ক
• শেখ হেলাল উদ্দিন স্টেডিয়াম
• রুপা চৌধুরী পৌর পার্ক
• ডিসি পার্ক, যাত্রাপুর

বাগেরহাট জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব

কবি ও সাহিত্যিক
• মতিউর রহমান মল্লিক (কবি ও সাহিত্যিক)
• রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ(কবি)
• নীলিমা ইব্রাহিম, (সাহিত্যিক)
• আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ(সাহিত্যিক, সংগঠক)
• মোহাম্মদ রফিক (কবি)
• আবুল হোসেন (কবি)
• মোহাম্মদ মোহর আলী (ইতিহাসবেত্তা)
• স্বরোচিষ সরকার, আভিধানিক ও বৈয়াকরণ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা
• লিয়াকত আলী খান (বীর উত্তম)
• খিজির আলী বীর বিক্রম
• মোহাম্মদ হোসেন বীর প্রতীক
• এনামুল হক (বীর প্রতীক)

রাজনীতিবিদ
• শেখ আবদুল আজিজ

খেলোয়াড়

• রুবেল হোসেন,ক্রিকেট (খেলোয়াড়)
• জুপিটার ঘোষ,ক্রিকেট (খেলোয়াড়)
• হেমায়েত মোল্লা,ক্যারম (খেলোয়াড়)

 

 

তথ্যসূত্র: জাতীয় তথ্যবাতায়ন, ওয়েবসাইট, ওয়েবব্লগ

আরও পড়তে পারেন ঢাকার ইতিহাস

Leave a Reply

%d bloggers like this: