বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি
চন্দ্রাবতী ছিলেন মনসামঙ্গলের অন্যতম কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা। তাঁদের নিবাস ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত পাঠবাড়ী বা পাতুয়ারী গ্রামে। এ দেশের প্রথম নারী কবি। তাঁর জীবনকাহিনি নাটকের চেয়েও নাটকীয়, বেদনাভারাতুর। সেই মধ্যযুগের কালপর্ব থেকে এখন অব্দি পালা রচিত হয়েই চলেছে এই মহীয়সীকে নিয়ে। এ সংখ্যায় রয়েছে চন্দ্রাবতীর সন্ধান। আর গোটা সংখ্যাজুড়ে আরও আছে আবহমান বাংলা সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ। বৈশাখের বিপুল বারতা।
চন্দ্রাবতী (১৬শ শতক) মধ্যযুগের তিনজন উল্লেখযোগ্য মহিলা কবির অন্যতম। অপর দুজন হলেন চন্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী রামতারা বা রামী এবং শ্রীচৈতন্যের কৃপাপাত্রী মাধবী।
দীনেশচন্দ্র সেনের মতে কবি চন্দ্রাবতী ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মৈমনসিংহ-গীতিকার ‘জয়-চন্দ্রাবতী’ উপাখ্যানের নায়িকারূপে তিনি অমর হয়ে আছেন। ময়মনসিংহ অঞ্চলে ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’ নামে একটি গাথা প্রচলিত আছে। চন্দ্রাবতী’ পালা থেকে জানা যায়, তিনি ও জয়ানন্দ ছেলেবেলা থেকেই একত্রে বেড়ে ওঠেন। গাথানুযায়ী রূপসী এই কবিএকই এলাকার ব্রাহ্মণ যুবক জয়চন্দ্রের প্রতি আশৈশব প্রণয়াসক্ত ছিলেন এবং পরিণত বয়সে দুপক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে বিবাহও স্থির হয়।
কিন্তু দৈবাৎ কমলা নামের এক মুসলিম যুবতীর প্রেমাসক্ত হয়ে প্রেমিক জয়চন্দ্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। পরে অবশ্য অনুতপ্ত জয়চন্দ্র চন্দ্রাবতীর নিকট ফিরে এলে করুনভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। তখন অভিমানী জয়চন্দ্র ফুলেশ্বরী নদীতে (মতান্তরে সুনন্দা নদীতে) প্রাণ বিসর্জন দিলে বেদনাহত চন্দ্রাবতীর শোক ভুলে থাকার অভিপ্রায়ে পিতার আদেশে রামায়ণকথা রচনায় প্রবৃত্ত হন। অবশ্য কাব্য রচনা সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই তাঁর প্রাণবিয়োগ ঘটে।
চন্দ্রাবতী প্রেমাস্পদ জয়চন্দ্রের বিচ্ছেদজ্বালা নিবারণের জন্য ফুলেশ্বরী নদীর তীরে পিতৃনির্মিত শিবমন্দিরে শিব-আরাধনায় কুমারী অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করেন। ৩৫৪ ছত্র ও ১২ অঙ্কে বিভক্ত নয়ান ঘোষ প্রণীত চন্দ্রাবতী পালায় কবি চন্দ্রাবতীর জীবনকাহিনী বিধৃত হয়েছে।
কবি চন্দ্রাবতীর সৃজনপ্রতিভার বাইরে ব্যক্তি চন্দ্রাবতীর জীবন এবং তাঁর প্রেমশোকগাথা লোকসমাজ-সাহিত্যে বেশি প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত। আজও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের স্মৃতি আর শ্রুতিতে কিংবদন্তি চরিত্ররূপে চন্দ্রাবতীর করুণ কাহিনি বহমান। এর পেছনে অবশ্য মৈমনসিংহ গীতিকায় অর্ন্তভুক্ত ‘চন্দ্রাবতী’ পালাটির বিস্তর ভূমিকা রয়েছে। কবির মৃত্যুর পর পালাটি রচনা করেছিলেন নয়নচাঁদ ঘোষ।
ষোড়শ শতকের মনসা মঙ্গলের বিখ্যাত কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা ও বঙ্গের আদি মহিলা কবিরূপে খ্যাত চন্দ্রাবতী -র বহু কাহিনী সমৃদ্ধ এ মন্দিরটি খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত। চন্দ্রবতী সম্ভবতঃ ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। পিতা ও কন্যা একত্রে মনসা দেবীর ভাসান ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেছিলেন।
এটি কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৬ কিঃ মিঃ । যাওয়ার মাধ্যম:- টেম্পু/রিক্সা।
চন্দ্রাবতী-র রামায়ণ প্রকাশঃ
১৯৩২ সালে দীনেশচন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। পূর্ববঙ্গ-গীতিকার চতুর্থ খন্ডের ২য় ভাগে এ রামায়ণ স্থান পেয়েছে। দীর্ঘদিন এ কাব্য পূর্ব ময়মনসিংহে ঘরে ঘরে পঠিত ও গীত হয়েছে। লৌকিক, মানবিক ও অন্যান্য মৌলিক উপাদানসমৃদ্ধ এ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।
বঙ্গের সুবিদিত লোকসাহিত্যগবেষক ও লেখক দীনেশচন্দ্র সেন ও ক্ষিতিশ চন্দ্র মৌলিকের সম্পাদনায় প্রকাশিত যথাক্রমে মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকায় ‘চন্দ্রাবতী’ পালাটি রয়েছে। এমনকি চন্দ্রাবতী লিখিত ‘মলুয়া’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’ ও ‘রামায়ণ’ পালাও এতে সংকলিত আছে। তাঁর রচিত গীতিকা ‘মলুয়া’ ও ‘দস্যু কেনারামের পালা’—এই দুই পালায় তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোকসমাজ ও সংস্কৃতির চিত্র মুনশিয়ানার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্থানে পঠিত ও মহিলাদের দ্বারা গীত হয়েছে তাঁর রামায়ণ গান। দস্যু কেনারামের গাথা কাহিনীটি ‘দ্বিজ বংশীসুতা’ এ ভণিতায় চন্দ্রাবতীর রচনা বলে চিহ্নিত হয়েছে। এ ছাড়া তিনি পদ্মাপুরাণ ও মলুয়া নামে আরও দুটি কাব্য রচনা করেন।
তাছাড়া চন্দ্রাবতী অজস্র লোকগীতি রচনা করেন। নৌকার মাঝির কণ্ঠে, ব্রতে, বিয়েতে এবং প্রতিদিনের গার্হস্থ্য জীবনে আজও শোনা যায় চন্দ্রাবতীর গান। ষোল শতকের সামাজিক-আর্থনীতিক অবস্থার স্বরূপ প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর রচনায়। চন্দ্রাবতীর স্মৃতি, রচনা, জীবন ও সাহিত্য আজও বহমান স্রোতোধারার মতো গবেষক ও পর্যটককে আকর্ষণ করে।
সংগৃহীত