বাংলাদেশ ইতিহাস

পঞ্চগড় জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

পঞ্চগড় জেলার পরিচিতি ও ইতিহাসপঞ্চগড় জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

পঞ্চগড়

হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযের লীলাভূমি এবং সবচেয়ে উত্তরের জেলা। উত্তরের প্রবেশদ্বার সবুজ চায়ের সমাহার খ্যাত পঞ্চগড় জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল।

পঞ্চগড় জেলার নামকরণের ইতিহাস:

• প্রাচীনকালে পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের অর্ন্তগত ‘পঞ্চনগরী’ নামে একটি অঞ্চল ছিল। কালক্রমে পঞ্চনগরী ‘পঞ্চগড়’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ‘পঞ্চ’ (পাঁচ) গড়ের সমাহার ‘পঞ্চগড়’ নামটির অপভ্রংশ ‘পঞ্চগড়’ দীর্ঘকাল এই জনপদে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই অঞ্চলের নাম যে পঞ্চগড়-ই ছিল সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যায় না। পঞ্চগৌড়ের একটি অংশ হিসেবে প্রাকৃত ভাষার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পঞ্চগড়ের নামকরণের সম্ভাবনা থেকে যায়। অর্থাৎ, পঞ্চগৌড় > পঞ্চগোড় > পঞ্চগড়।

• অবশ্য আরেকটি বহুল প্রচলিত ধারণা মতে, এই অঞ্চলের পাঁচটি গড়ের সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণেই “পঞ্চগড়” নামটির উৎপত্তি। ‘পঞ্চগড়’ হলো এই ‘পঞ্চ’ (পাঁচ) গড়ের সমাহার। গড়গুলো হলো: ভিতরগড়, মিরগড, রাজনগড়, হোসেনগড় এবং দেবনগড়।

• আবার কিছুটা ভিন্ন মতে, ‘পঞ্চ’ শব্দের অর্থ ‘পাঁচ’, আর ‘গড়’ শব্দের অর্থ ‘বন বা জঙ্গল’। ভারত বিভাগের আগে এই অঞ্চল জঙ্গলাকীর্ণ থাকায়, তা থেকেও এলাকার নাম হতে পারে ‘পঞ্চগড়‘। যদিও বর্তমানে জনবসতি গড়ে ওঠায় বন্যভূমি প্রায় নেই বললেই চলে।

পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস:

প্রাগৈতিহাসিক থেকে মধ্যযুগ

পঞ্চগড় একটি প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন ও মধ্য যুগে এই ভূখন্ডের পাশেই ছিল মগধ, মিথিলা, গৌড়, নেপাল, ভূটান, সিকিম ও আসাম রাজ্যের সীমান্ত। আধুনিককালের মত অতীত কালেও জনপদটি ছিল সীমান্ত অঞ্চল। এই ভূখন্ডটি পর্যায়ক্রমে শাসিত হয়েছে প্রাগজ্যোতিষ, কামরূপ, কামতা, কুচবিহার ও গৌর রাজ্যের রাজা, বাদশা, সুবাদার এবং বৈকুন্ঠপুর অঙ্গ রাজ্যের দেশীয় রাজা ও ভূ-স্বামীদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে। খ্রিস্টীয় ২য়, ৩য় শতকের মধ্যে রাজা ‘শালিবাহন’, রাজা ‘পৃথু’ এবং রাজা ‘জল্লেশ’ পঞ্চগড়ের শালবাহান ও ভিতরগড় এলাকায় নগর ও সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে তুলেছিলেন। মৌর্য, গুপ্ত ও পাল রাজারাও এই অঞ্চল শাসন করেছিলেন।

মধ্যযুগের শুরুতেই প্রথম মুসলিম বঙ্গবিজয়ী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজী তার বহু বিতর্কিত তিব্বত অভিযানের এক পর্যায়ে পঞ্চগড় জনপদের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন বলে জানা যায়। সুলতান হোসেন শাহ এবং কামতার রাজা নীলধ্বজ তেঁতুলিয়া থানার দেবনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে কোন কোন ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেন। সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহ, সুলতান বারবক শাহ, শেরশাহ, খুররম খাঁ (শাহজাহান), মীরজুমলা, সুবাদার ইব্রাহীম খাঁ ফতে জঙ্গ এবং অন্ত মধ্যযুগে দেবী চৌধুরাণী, ভবানী পাঠক, ফকির মজনুশাহ প্রভৃতি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পঞ্চগড় জনপদের নাম ও স্মৃতি নিবিড়ভাবে জড়িত। ষোড়শ শতকে কুচবিহার রাজ্য গঠিত হওয়ার পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পঞ্চগড় অঞ্চল মূলত কোচ রাজন্যবর্গের দ্বারাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাসিত হয়েছে।

ভারত বিভাগ ও আধুনিক যুগ

বৃটিশ শাসনামলে এ জেলাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পঞ্চগড় থানাটি দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার অর্ন্তভূক্ত হয়। ১৯৮০ সালে ১ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও মহকুমার ৫টি থানা তেতুলিয়া, পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারী, বোদা ও দেবীগঞ্জ নিয়ে পঞ্চগড় মহকুমা সৃষ্টি হয়। মহকুমার সদর দপ্তর পঞ্চগড় থানায় স্থাপিত হয়। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন সৈয়দ আব্দুর রশিদ (১৯৮০-১৯৮২) । ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড় মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়। পঞ্চগড় জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আ.স.ম. আব্দুল হালিম (১৯৮৪-১৯৮৫)

পঞ্চগড় জেলার ঐতিহ্য

পঞ্চগড় জনপদে মানব বসতি শুরু হয়েছে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে। বাংলাদেশের এই প্রান্ত অঞ্চলে দীর্ঘকাল ব্যাপ্ত পুন্ড্র, গুপ্ত, পাল, সেন ও মুসলিম শাসকগণের সংস্পর্শে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য প্রত্ন নিদর্শন। এ সবের মধ্যেই রয়েগেছে অতীতের বহু গৌরব-গাঁথা বহু দীর্ঘশ্বাস ও প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের অগনিত স্মৃতি চিহ্ন। একটি শহরকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে উপাদান প্রয়োজন তার সবই বিদ্যমান রয়েছে পঞ্চগড় জেলায়।

পঞ্চগড় জেলার আইন শৃংখলা পরিস্থিতি বাংলাদেশের যে কোন জেলার চেয়ে ভাল। পঞ্চগড়ের মানুষজন অতি সহজ সরল এবং অতিথি পরায়ন। পঞ্চগড় থেকে হেমন্ত ও শীতকালে পর্যক্ষেণ করা যায় কাঞ্চনজংঘার অপরূপ দৃশ্য যা পর্যটকদের অতি সহজে আকৃষ্ট করে। পঞ্চগড়ে রয়েছে সমতল ভূমিতে চা বাগানের আনন্দ সৌন্দর্য্য। রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র রকস মিউজিয়াম। রয়েছে মহানন্দা নদীর তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক ডাকবাংলো যেখান থেকে দুই বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

ভৌগোলিক অবস্থান

পঞ্চগড় জেলার আয়তন প্রায় ১,৪০৪.৬২ বর্গ কি.মি. বা ৫৪২.৩৩ বর্গমাইল। বাংলাদেশের সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের স্থানাঙ্ক প্রায় ২৬.২৫° উত্তর অক্ষাংশে ৮৮.৫০° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। পঞ্চগড় জেলার উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং জেলা, উত্তর-পশ্চিমে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা, দক্ষিণে ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলা, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর ও পূর্ণিয়া জেলা এবং পূর্বে নীলফামারী জেলা অবস্থিত। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের জন্য স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ নির্ধারিত সীমানা অনুযায়ী পঞ্চগড় জেলার তিনদিকে প্রায় ১৮০ মাইল বা ২৮৮ কি.মি. জুড়ে ভারতের সীমান্ত অবস্থিত।

পঞ্চগড় জেলার প্রধান নদ-নদী:

পঞ্চগড়ে ২৩টি নদী রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রধান নদী হলো করতোয়া, তিস্তা, নাগর, মহানন্দা, টাঙ্গন, দহুক, পথরাজ, ভুলি, তালমা, চাওয়াই, কুরুম, তিরোনি এবং চিলকা।

উপজেলা:

পঞ্চগড় জেলায় মোট পাঁচটি উপজেলা রয়েছে। যথা:

• আটোয়ারী উপজেলা,
• তেতুলিয়া উপজেলা,
• দেবীগঞ্জ উপজেলা,
• পঞ্চগড় সদর উপজেলা ও
• বোদা উপজেলা।

পঞ্চগড় জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ:

• ভিতরগড়
• মহারাজার দিঘী
• বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির
• সমতল ভূমিতে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত চা বাগান
• মির্জাপুর শাহী মসজিদ
• মির্জাপুর ইমামবাড়া
• বার আউলিয়ার মাজার
• গোলকধাম মন্দির
• ছেপড়াঝাড় মসজিদ

• তেঁতুলিয়া ডাক-বাংলো
• তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্ণার
• বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট ও বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর
• রকস্ মিউজিয়াম
• মহারাণী বাঁধ
• মিরগড়
পঞ্চগড় এর এশিয়ান হাইওয়ে

পঞ্চগড় জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব:

• ডা. সলিমুল্লাহ
• গমির উদ্দীন প্রধান
• ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান
• বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম
• কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ
• ব্যারিস্টার মুহাম্মদ জমিরউদ্দীন সরকার
• মির্জা গোলাম হাফিজ
• মো. মোজাহার হোসেন
• চিত্রনায়ক আব্দুর রহমান

 

তথ্যসূত্র: জাতীয় তথ্য বাতায়ন, উইকিপিডিয়া

আরও পড়তে পারেন: খুলনা জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস

Leave a Reply

%d bloggers like this: