স্বাস্থ্যহেলথ টিপস

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসাডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

ডায়াবেটিস

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে রোগটির সম্পর্কে আমরা সবচেয়ে বেশি শুনতে পাই সেটা হল ডায়াবেটিস। বর্তমানে বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪২ কোটিরও অধিক। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৭০ লক্ষেরও বেশি। অজ্ঞতা ও গুরূত্বহীনতার কারণে যাদের ৫৭ শতাংশই জানেন না যে, তাদের ডায়াবেটিস আছে!

ডায়াবেটিস কী?

ডায়াবেটিস মেলিটাস (Diabetes mellitus) বা বহুমূত্র রোগ হল ইনসুলিন হরমোন (Insulin Hormone) সংশ্লিষ্ট বিপাকজনিত একটি রোগ। দেহের অগ্ন্যাশয় (Pancreas) যদি প্রয়োজনীয় যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে অথবা শরীর যদি উৎপন্ন ইনসুলিন ঠিকভাবে ব্যবহারে ব্যর্থ হয়, তাহলে যে রোগ হয় তা হল ‘ডায়াবেটিস‘ বা ‘বহুমূত্র রোগ’। ডায়াবেটিস কোন সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ নয়। এই রোগ হলে রক্তে চিনি বা শকর্রার উপস্থিতিজনিত ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।

অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন হরমোনের সহায়তায় দেহের কোষগুলো রক্ত থেকে গ্লুকোজকে নিতে সমর্থ হয় এবং একে শক্তির জন্য ব্যবহার করতে পারে। ইনসুলিন উৎপাদন বা ইনসুলিনের কাজ করার ক্ষমতা-এর যেকোনো একটি বা দুটোই যদি ঠিকভাবে না হয়, তাহলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় এবং পরবর্তীতে তা প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে আসে। এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়, দেহের টিস্যু ও যন্ত্র বিকল হতে থাকে।

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগের ধরনসমূহ:

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ বললে সাধারাণত ডায়াবেটিস মেলিটাস (Diabetes mellitus) -কে বোঝায়। তবে ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস (Diabetes insipidus) নামে আরেকটি রোগ আছে যা অ্যান্টি ডাইইউরেটিক হরমোন (Anti Diuretic Hormone) নামে অন্য একটি হরমোনের উৎপাদনের অভাব বা ক্রিয়ার অভাবে হয়ে থাকে । এই রোগটিতে মূত্র উৎপাদন বেশি হয় এবং ফলশ্রুতিতে তৃষ্ণা অতিরিক্ত হয়। এই দুটি মিল ছাড়া এই রোগটির সঙ্গে “ডায়াবেটিস মেলিটাস” -এর কোন সম্পর্ক নেই। এ দুটির মধ্যে ডায়াবেটিস মেলিটাসের প্রকোপ অনেক বেশি।

ডায়াবেটিস মেলিটাস আবার বিভিন্ন রকম হতে পারে।

টাইপ-১ বা ইনসুলিন নির্ভর:

টাইপ-১ ডায়াবেটিস হল অটোইমিউন রোগ (autoimmune disease) । এ রোগে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায় ও দেহে ইনসুলিন উৎপাদন হয় খুবই কম। ফলে রোগীকে বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। অন্যথায় রক্তের শর্করা অতি দ্রুত বেড়ে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই রক্তে অম্লজাতীয় বিষক্রিয়ায় অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ১০-৩০ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে এই ধরনের বহুমূত্র বেশি হয়। এটি মূলত বংশগত কারণে হয়ে থাকে।

টাইপ-২ বা ইনসুলিন নিরপেক্ষ ডায়াবেটিস:

টাইপ-২ রোগীরা শরীরে যে ইনসুলিন উৎপন্ন হয় তা ব্যবহার করতে পারে না। ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স’ (insulin resistance) মূলত এর জন্য দায়ী। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হল এমন একটি শারীরিক অবস্থা যার কারণে শরীরে ইনসুলিন তৈরি হলেও তা ঠিকভাবে কাজ করেনা এবং রক্তে গ্লুকজের মাত্রা বেড়ে যায়। সাধারণত ৪০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সীদের এ ধরনের বহুমূত্র রোগ দেখা দেয়। ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ শতাংশের বেশি হল টাইপ-২ ডায়াবেটিস। দুই ধরনের ডায়াবেটিসই গুরুতর এবং শিশু ও তরুণদেরও হতে পারে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস:

গর্ভবতী অবস্থায় অনেক সময় প্রসূতিদের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। কিন্তু সন্তান প্রসবের পর ডায়াবেটিস আর থাকে না। এই ধরনের জটিলতাকেই গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes) বলা হয়। গর্ভবতী মহিলাদের ডায়াবেটিস হলে তা গর্ভবতী মা ও গর্ভের শিশু উভয়ের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই বিপদ এড়ানোর জন্য গর্ভকালীন অবস্থায় ইনসুলিনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার বিকল্প নেই।

নির্দিষ্ট কারণভিত্তিক শ্রেণি:

• জেনেটিক বা বংশগত কারণে কম ইনসুলিন তৈরি হওয়া।
• জেনেটিক বা বংশগত কারণে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া।
• বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধির কারণে।
• অগ্ন্যাশয়ের বিভিন্ন রোগের কারণে।
• ঔষধ ও রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসলে।
• অন্যান্য হরমোনের পরিমান বৃদ্ধি পেলে।
• রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার কারণসমূহ:

যে কেউ যেকোনো বয়সে যেকোনো সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে নিম্নোক্ত শ্রেণির ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে:

• যাদের বাবা-মা’র বা বংশে ডায়াবেটিস আছে।
• যাদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ও যারা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করেন না।
• যারা দীর্ঘদিন ধরে কর্টিসোল (Cortisol) জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করেন।
• যেসব মহিলার গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ছিল, বা যাদের পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রম (Polycystic Ovary Syndrome) থাকে এবং   যেসব মহিলা ৯ পাউন্ডের বেশি ওজনের বাচ্চা প্রসব করেছেন।
• যাদের উচ্চরক্তচাপ আছে এবং রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বেশি ।
• যারা অত্যধিক মানসিক চাপ, পারিবারিক জটিলতা, অতিরিক্ত কাজের চাপে থাকেন
• টাইপ -২ ডায়াবেটিস হওয়ার অন্যতম কারণ হল শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকা অর্থাৎ ব্যায়াম না করা।
• আমাদের দৈনন্দিন পরিশ্রমের পর পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। ন্যাশনাল স্লিপ ফাউণ্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ঘুম কম হলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়।
• সকালের নাস্তা না খাওয়া ও রাতে বেশি খাওয়া

ডায়াবেটিসের সাধারণ লক্ষণসমূহ:

• প্রস্রাব খুব ঘন ঘন হওয়া।
• খুব বেশি পানি পিপাসা লাগা।
• কিছুক্ষণ পর পর ক্ষুধা লাগা।
• অল্পতেই শরীরে ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভূত হওয়া।
• স্বাভাবিক খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া।
• যেকোনো ধরনের ক্ষত শুকাতে স্বাভাবিকের তুলনায় সময় বেশি লাগা।
• বিভিন্ন রকম চর্মরোগ যেমন- খোশ-পাঁচড়া, ফোঁড়া ইত্যাদি দেখা দেওয়া।
• দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া।
• জিভ শুকিয়ে যাওয়া।
• চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে ও চুলকানিভাব।

কিভাবে বুঝবেন আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে?

ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ দীর্ঘস্থায়ীভাবে বেড়ে যায়। সুস্থ লোকের রক্তের প্লাজমায় গ্লুকোজের পরিমাণ অভুক্ত অবস্থায় ৫.৬ মিলি মোলের কম (less than 5.6 mili mol) এবং খাবার দুই ঘণ্টা পরে ৭.৮ মিলি মোলের কম (less than 7.8 mili mol) থাকে। অভুক্ত অবস্থায় রক্তের প্লাজমায় গ্লুকোজের পরিমাণ ৭.১ মিলি মোলের বেশি হলে অথবা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে রক্তের প্লাজমায় গ্লুকোজের পরিমাণ ১১.১ মিলি মোলের বেশি হলে ডায়াবেটিস হয়েছে বলে গণ্য করা হয়।

ডায়াবেটিস রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি সমূহ:

কোন ব্যক্তির টাইপ-১ অথবা টাইপ-২ আছে কিনা তা নির্ণয় করার জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে এবং গর্ভকালীন ডায়বেটিস শনাক্তকরণে একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT):

ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট ডায়বেটিস নির্ণয় করার জন্য বিশ্ব স্বীকৃত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে রোগী খালি পেটে থাকাকালীন রক্তে শর্করার পরিমাণ পরিমাপ করা হয়। তারপরে রোগীকে একটি চিনিযুক্ত তরল পান করতে দেওয়া হয় এবং রক্তের শর্করার মাত্রা দুই ঘন্টা পর আবার পরীক্ষা করা হয়। খালি পেটে রক্তের শর্করার মাত্রা ৫.৬ মিলি মোলের বেশি (less than 5.6 mili mol) এবং দুই ঘন্টা পরে ৭.৮ মিলি মোলের কম (less than 7.8 mili mol) ডায়াবেটিস নেই বলে ধরা হয়।

রেন্ডম ব্লাড সুগার (RBS):

রেন্ডম ব্লাড সুগার (RBS) পরীক্ষা করে গ্লুকোজের মাত্রা ১১.১ মিলিমোল/লিটার (mmol/l) অথবা তার বেশি পাওয়া গেলে ধারণা করা হয় তার ডায়াবেটিস আছে। যদি গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক অর্থাৎ ৫- ১১.১ মিলিমোল/লিটার (mmol/l) এর মধ্যে থাকে, পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য OGTT পরীক্ষা করতে হবে।

ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS):

ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS) পরীক্ষা RBS এর চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। কারো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা সকালে খালি পেটে ৭.০ মিলিমোল/লিটার বা তার বেশি হলে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় ডায়াবেটিস হয়েছে এবং যদি ৬.১-৬.৯ মিলিমোল/লিটার ভিতরে থাকে তাহলে বুঝতে হবে ব্যক্তির ডায়াবেটিস হয়নি কিন্তু হওয়ার পথে রয়েছে।

গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন এ১ সি (HbA1c):

এটি একটি রক্ত পরীক্ষা, যার জন্য খালি পেটের প্রয়োজন হয় না। এই পরীক্ষা গত ২-৩ মাস ধরে আপনার রক্তে গড় শর্করার মাত্রা নির্দেশ করে। এটি নির্দেশ করে রক্তের শতকরা কত ভাগ শর্করা হিমোগ্লোবিনের সাথে সংযুক্ত হয়। আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা যত বেশি হবে আপনার শর্করাও তত বেশি হিমোগ্লোবিন এর সাথে লাগবে। দুটি পৃথক পরীক্ষায় যদি হিমোগ্লোবিন এ১ সি এর মাত্রা ৬.৫ শতাংশ বা তারও বেশি হয় তবে আপনার ডায়াবেটিস রয়েছে। ৫.৭ থেকে ৬.৪ শতাংশের মধ্যে থাকলে তা প্রি-ডায়বেটিস নির্দেশ করে। ৫.৭ শতাংশের নিচে থাকলে তার ডায়াবেটিস নেই বলে বিবেচিত হয়।

গর্ভকালীন ডায়বেটিস শনাক্তকরণ:

গর্ভকালীন মায়েদের ডায়াবেটিস আছে কিনা তা জানার জন্য জিসিটি (GCT) নামে একটি পরীক্ষা পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতিতে দিনের যেকোন সময়ে (খালি বা ভরা পেট যেকোন ভাবে) গর্ভকালীন সময়ে মা’কে ৫০ গ্রাম গ্লুকোজের শরবত খাওয়ানোর ১ ঘণ্টা পরে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। গ্লুকোজের মাত্রা ৭.৮ মিলিমোল/লিটার বা তার চেয়ে বেশি হলে তাকে জিসিটি পজিটিভ হিসেবে ধরে নিতে হবে। GCT পজিটিভ হলে অবশ্যই ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স পরীক্ষা করতে হবে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে যেসব রোগ হতে পারে:

ডায়াবেটিসকে অন্যান্য রোগের সূতিগাকার বলা হয় কারণ দীর্ঘসময় ধরে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, কিডনীর কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়া, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, পায়ে পচনশীল ক্ষত, চক্ষুরোগ, পক্ষাঘাত, স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা, মুত্রাশয়ের রোগ, প্রস্রাবে আমিষ বের হওয়া, যক্ষা, মাড়ির প্রদাহ, পাতলা পায়খানা, চুলকানি, ফোঁড়া, যৌন ক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে অকালে সন্তান প্রসব, জন্মের পর পরই শিশুর মৃত্যু, বেশি ওজনের শিশু হওয়া, মৃত শিশুর জন্ম, অটিজম ইত্যাদি নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়:

• ডায়াবেটিস হলে চিকিৎসকের পরামর্শনুযায়ী খাদ্যের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা ও খাদ্য গ্রহণে নিয়ন্ত্রণ আনা সবচেয়ে জরুরি। শরীরে খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা ডায়াবেটিস হওয়ার আগে ও পরে একই রকম থাকে। তাই, খাদ্যের নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্যও ভাল রাখা যায়। ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ, তাই সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণে এই রোগকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

• ডায়াবেটিক রোগীদের অবশ্যই নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম করা এবং শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীর সু্‌স্থ থাকার পাশাপাশি ইনসুলিনের কার্যকারিতা ও নি:সরণের পরিমাণ বেড়ে যায়। প্রতিদিন কমপক্ষে ৪৫ মিনিট হাঁটলে শরীর যথেষ্ট সু্‌স্থ থাকবে। শারীরিক অসুবিধা থাকলে, যতটুকু সম্ভব কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। বিশেষ করে বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে এগুলো যথাযথভাবে পালন করতে পারলে রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

• টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশনের প্রয়োজন হতে পারে। টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসক শর্করা কমাবার জন্য খাবার বড়ি দিতে পারেন।
• চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার পরিমিত খাওয়া।
• চাল, আটা এবং মিষ্টি ফল ইত্যাদি হিসেব করে খাওয়া।
• ডাল, শাক, সবজি, টক জাতীয় ফল ইত্যাদি আঁশবহুল খাবার বেশি খাওয়া।

• উদ্ভিজ্জ তেল অর্থাৎ সয়াবিন, সরিষার তেল ইত্যাদি এবং সব ধরনের মাছ খাওয়ার অভ্যাস করা।
• ওজন স্বাভাবিক রাখা।
• মাংস, চর্বি, ঘি, মাখন, ডালডা ইত্যাদি ফ্যাট জাতীয় খাবার যতটা সম্ভব কম খাওয়া।
• অন্য কোনও রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্যব্যবস্থা গ্রহণ করা।
• ধূমপান বন্ধ করতে হবে।
• নিয়মিত প্রস্রাব (Urine) পরীক্ষা করতে হবে
• ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা বন্ধ রাখা যাবে না।
• শারীরিক কোন অসুবিধা দেখা দিলে দেরী না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

ডায়াবেটিসের চিকিৎসা:

রক্তে শকর্রার স্বল্পতা বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমানোর জন্য ট্যাবলেট অথবা ইনসুলিন দেয়া হয়। ট্যাবলেট খাওয়ার বা ইনসুলিন নেয়ার ফলে যদি শর্করার পরিমাণ খুব কমে যায় তাহলে শরীরে কিছু প্রতিক্রিয়া, যেমন- অসু্‌স্থ বোধ করা, বুক ধড়ফড় করা, শরীর কাঁপতে থাকা, বেশি ঘাম হওয়া, শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, অস্বাভাবিক আচরণ করা, খুব বেশি খিদে পাওয়া ইত্যাদি হতে পারে।

ট্যাবলেট বা ইনসুলিন গ্রহণের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হলে, ইনসুলিন ও সিরিঞ্জ একই মাপের না হলে, খুব কম খেলে বা খাবার না খেলে, ইনসুলিন গ্রহণের পরে খুব দেরী করে খাবার খেলে এ সমস্যাগুলো হতে পারে। রক্তে শকর্রার অভাব হলে রোগীকে চা-চামচের ৪ থেকে ৮ চামচ গ্লুকোজ বা চিনি এক গ্লাস পানিতে গুলে খাইয়ে দিতে হবে অথবা গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে হবে এবং দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

আবার, অপর্যাপ্ত ইনসুলিন নিলে অথবা ইনসুলিন নির্ভর রোগী ইনসুলিন একেবারেই না নিলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। শরীরে ইনসুলিনের অভাব হলে, ইনসুলিনের অভাবে রক্তের শর্করা শরীরের কোন কাজে লাগতে পারে না, তখন তাপ ও শক্তির জন্য দেহে সঞ্চিত চর্বি ব্যবহার হতে থাকে। কিন্তু পর্যাপ্ত ইনসুলিনের অভাবে এই চর্বি অধিক হারে ভাঙ্গার ফলে রক্তে কিছু ক্ষতিকর পদার্থ ও অম্ল বেড়ে যায়, ফলে এসিটোন (Acetone) নামক একটি কিটোন (ketone) বডিতে অধিক পরিমাণে বেড়ে গেলে, অম্লতার জন্য রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। এই অবস্থাকে বলে ডায়াবেটিক কোমা (diabetic coma)।

প্রস্রাবে শর্করার পরিমাণ খুব বেশি বেড়ে গেলে, খুব বেশি বা ঘন ঘন পিপাসা লাগলে, ঘন ঘন প্রস্রাব হলে, বেশি বেশি ক্ষুধা লাগলে, খুব অসু্স্থ বোধ হলে, বমি বমি ভাব হলে, শরীরে দুর্বলতা অনুভূত হলে, ঝিমানো ভাব, শ্বাস কষ্ট হলে, নিঃশ্বাস দ্রুত হলে, প্রচণ্ড মাথা ধরলে, নিস্তেজ অনুভূত হলে ইত্যাদি ডায়াবেটিক কোমার লক্ষণ। এই লক্ষণ গুলি দেখা দিলে শরীরে পানি স্বল্পতা কমানোর জন্য অতিরিক্ত লবণ মিশ্রিত পানি খেতে হবে, ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং প্রস্রাবে কিটোন বডি আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে এবং দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

পরিশেষ
ডায়াবেটিস রোগটি আজীবনের রোগ। এটি কখনোই সম্পূর্ণরূপে সেড়ে যায় না। তবে সচেতন হলে এবং সুচিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগকে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যেমন কমে যাওয়ার পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে পারার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।

 

 

আরও পড়তে পারেন: অটিজম কী, অটিস্টিক শিশুর লক্ষণ ও চিকিৎসা

তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশন, উইকিপিডিয়া, ই-হসপিটাল

Leave a Reply

%d bloggers like this: