সিলেট
জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল । এটি সিলেট বিভাগের একটি জেলা । বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত এ জেলা দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী ও বিশ্বের দ্বিতীয় লন্ডন হিসেবে খ্যাত। জৈন্তিয়া পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য, জাফলং এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, ভোলাগঞ্জের সারি সারি পাথরের স্তূপ, পাথরের বিছানাখ্যাত বিছনাকান্দি, রাতারগুল জলাবন পর্যটকদের টেনে আনে বার বার।
সিলেট জেলার নামকরণের ইতিহাস:
• সবচেয়ে প্রচলিত ধারণাটি হলো, শিলা মানে পাথর। আর পাথরের প্রাচুর্যের কারণেই এ এলাকার নাম সিলেট। এ ধারণার পালে আর একটু হাওয়া দিয়ে বলা হয়ে থাকে, সিলেট শব্দের অনুসর্গ সিল মানে শীল বা পাথর আর উপসর্গ হেট মানে হাট বা বাজার। প্রাচীনকাল থেকে এ জেলায় পাথর ও হাটের আধিক্য থাকায় শব্দ দু’টি মিলে সিলেট নামের উৎপত্তি।
• হিন্দু মিথ বলছে, কন্যা শীলাদেবীর নামে হাট স্থাপন করেন প্রাচীন গৌড়ের রাজা গুহক। তখন শিলার নামের সঙ্গে হাট জুড়ে নাম হয় শীলাহাট। কালক্রমে শিলাহাট থেকে সিলট, সবশেষে সিলেট নামটি টিকে যায়।
• পুরাণে বলা হচ্ছে, বিষ্ণু চক্রে খণ্ডিত সতীর শবদেহের যে ৫১টি খণ্ড উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয় তার মধ্যে দু’টি পড়ে সিলেটে। যেহেতু সতীর অপর নাম শ্রী। তাই এই শ্রী এর সঙ্গে হড্ড (হাড়) জুড়ে নাম হয় শ্রীহট্ট। যা পরে সিলেট নামে পরিচিতি পায়। বিষয়টাকে এভাবেও বলা যায়, শ্রী অর্থ প্রাচুর্য বা সৌন্দর্য, হস্ত অর্থ হাত। যেখানে শ্রী এর হস্ত পাওয়া গিয়েছিল তাই শ্রীহস্ত- যা কালের বিবর্তনে শ্রীহট্ট নাম ধারণ করে।
• তবে হজরত শাহজালালের (র.) ‘সিল হট যাহ্’ আদেশ থেকে সিলেট নামের উৎপত্তি বলেও ধারণা প্রচলিত আছে। সিলেটে আসার সময় পথে অনেক বড় বড় পাথর পড়ায় শাহজালাল আদেশ করেন-সিল হট যাহ (পাথর সরে যা)। ওই আদেশে পাথর খণ্ড সরে গেলে সিলহট নামটির জন্ম হয়, যা পরে সিলেট নামে পরিচিতি পায়।
• সুলতানি আমলে সিলেটের নাম ছিল জালালাবাদ। মহারাজা শ্রীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, দশম শতাব্দীতে বাংলায় চন্দ্র বংশের রাজত্বকালে তিনি এ জেলা জয় করেছিলেন। তার অধীনে শ্রীহট্টমণ্ডল নামে প্রশাসনিক বিভাগ গড়ে ওঠে যা সামন্ত রাজাদের হাতে শাসিত হতো।এই শ্রীহট্টমণ্ডল থেকেই কালক্রমে শ্রীহট্ট বা সিলহেট, সবশেষে সিলেট নামের উৎপত্তি।
• খ্রীষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম পরিব্রাজক মনিষী আল্ বেরুনীর ‘কিতাবুল হিন্দ’ গ্রন্থে সিলেটকে ‘সীলাহেত’ বলে উল্লেখ করা হয়। ইংরেজ আমলে কাগজ-পত্রে প্রথমে ‘Silhet’ বলে উল্লেখ থাকলেও উনবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে কাছাড় ইংরেজ অধিকারে আসার পর জেলার সদর স্টেশন ‘Silchar’থেকে পার্থক্য দেখাবার জন্য ‘Sylhet’ বলে উল্লেখ করা হয়। এভাবে আজকের সিলেট নামের গোড়াপত্তন হয়।
• ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে চীন দেশীয় বৌদ্ধ পন্ডিত ও পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সিলেটকে শি-লি-চা-ত-ল’ বলে উল্লেখ করেছেন।
সিলেট জেলার ইতিহাস:
আর্য যুগ
ঐতিহাসিক সৈয়দ মুর্তাজা আলী’র মতে পঞ্চম হতে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে আর্যরা এই অঞ্চলে এসেছে। আর্যরা আসার পূর্বে অস্ট্রিক ও মঙ্গোলীয় নরগোষ্টি ছিল এ অঞ্চলের আদিম আধিবাসী। উক্ত জাতিগোষ্ঠির বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় -তাদের (অস্ট্রিক ও মঙ্গোলীয় নরগোষ্টি) দেহের গঠন মাঝারি ধরনের, বাঁকা চোখ, গায়ের রং শ্যামলা ছিল। তারা হাড় ও পাথর দিয়ে অস্ত্র তৈরী করতো। ধান, পান, সুপারী, আদা, কলা ও হলুদ ছিল ঐ জাতিগোষ্ঠীর লোকের প্রাধান কৃষিজাত বস্তু। এছাড়া অস্ট্রিক ও মঙ্গোলীয় উভয় নরগোষ্ঠী ডিঙ্গি নৌকা ও ভেলা চড়ে জলপথে যাত্রা করত এবং নদী, খাল, হাওর ও বিলে মাছ ধরে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরী করে রাখতো। যা তাদের খাদ্য সংকটে ব্যবহারে লাগতো। পরবর্তিতে অনুমানীক পঞ্চম শতকে নাক লম্বা, মাথা মোটা, গৌর বর্ণের আর্যজাতীর এ অঞ্চলে আগমন ঘটে এবং হিন্দু বর্ণের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। ১৮৭২ সালে ভাটেরায় প্রাপ্ত তাম্রলিপি থেকে জানা যায় নবনীর্বান, গণগুণ নারায়ন ও গোবিন্দকেশব দেব নামক রাজাগণ এ অঞ্চলে এক সময় রাজত্ব করেছেন।
মুসলিম শাসিত আমল
১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে শাহ জালাল কর্তৃক ৩৬০ আউলিয়ার মাধ্যমে সিলেট বিজয় সম্পূর্ণ হয় বলে স্বীকৃত। এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে সিলেটে সুলতানী শাসনের সূত্রপাত ঘটে। সুলতানদের আমলে এ অঞ্চলের প্রশাসন ব্যবস্থাকে কয়েকটি ইকলিমে বা ইক্তায় বিভক্ত করা হয়। ইক্তার প্রাশাসককে ওজীর বলা হত। সিলেটের সর্ব প্রথম ওজীর হন সিকান্দর খান গাজী। এ সময় দিল্লীর সুলতানী পদে উপবিষ্ট ছিলেন আলাউদ্দীন খিলজী এবং বাংলার তত্কালীন সম্রাট ছিলেন শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহ। সিকান্দর গাজী কয়েক বত্সর শাসন পরিচালনা করেন এবং শাহ জালাল জীবিত থাকা কালেই সিকান্দর গাজী এক নৌকা ডুবিতে মৃত্যু বরণ করেন। এ বিষয়টি তোয়ারিখে জালালী গ্রন্থে কবিতায় এ ভাবে উল্লেখ আছেঃ
যখনে মরিল সেই গাজী সিকান্দর
বেসরদার হৈল ছিলট নগর
এজন্যে হযরত শাহ জালাল এমনি
নিযুক্ত করি দেন সরদার তখনি
সিকান্দর গাজীর পরে শাহ জালালের অন্য সঙ্গী অনুসারী হায়দর গাজী উপর সিলেটের শাসন ভার ন্যস্ত হয়।হায়দর গাজীর মৃত্যুর পর কার দ্বারা সিলেটের শাসন পরিচালিত হয়, তা অজ্ঞাত । অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির ধারণা করেন; হায়দর গাজীর পরে নবাব ইস্পেন্দিয়ার দ্বারা শাসিত হতে পারে। অতপর দিনাজপুরের রাজা গণেশ কর্তৃক গৌড়াধিপতি শামস উদ্দীন যখন নিহ্ত হন তখন সিলেটের শাসনকার্য কি ভাবে চলে ছিল তা জ্ঞাত হওয়া যায় নাই। এরপর গৌড় সম্রাট ইলিয়াছ বংশীয় বরবক শাহের পর ইউছুফ শাহের আমলে (১৪৮২ পূর্ব) সিলেটের সাথে গৌড়ের সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
শাহ জালালের দরগাহে প্রাপ্ত প্রস্তরলিপিতে ইউছুফ শাহের নাম অঙ্কিত থাকা এর প্রমাণ বলে অচ্যুতচরণ চৌধুরী মনে করেন। এ বংশীয় গৌড়ের শেষ রাজা মোজাফরের আমল (১৪৯৫ খ্রিঃ) পর্যন্ত গৌড়ের ছত্র-ছায়ায় থাকিয়া শাহ জালালের দরগাহের খাদিম গণ দ্বারা সিলেটের শাসন দণ্ড পরিচালিত হয়। অতঃপর হুসেন শাহের আমলে ময়মনসিংহ, ঢাকা, নেত্রকোনা, কিশুরগঞ্জ সহ সিলেটের সুনামগঞ্জ এলাকার নিম্না অঞ্চল নিয়ে ইকলিমে মুয়াজ্জমাবাদ নামে একটি প্রশাসনিক ইউনিট (প্রদেশ) ঘটিত হয়। এ সময় গৌড় হতে নিয়োজিত কানুনগো (দেওয়ান) গণ কর্তৃক সিলেট শাসিত হতো।
মোঘল শাসনামল
দিল্লীর মোঘল সম্রাট বাবরের পরে তার পুত্র হুমায়ুন সম্রাট হওয়ার পর হুমায়ুন ও শের শাহের বিগ্রহ কালে (১৫৩৭ সালে ) বাংলার দেওয়ান ও কিছু কিছু জমিদারবর্গ স্বাধীনতা লাভে বিদ্রোহ গড়ে ছিল । এ সময় খোয়াজ ওসমান নামক এক বিদ্রোহী ইটা ও তরফ রাজ্য অধিকার করে। তখনকার সময়ে শ্রীহট্টের গৌড়রের শাসন কর্তা ইউসুফ খাঁ’র সাথে বিদ্রোহ খোয়াজ ওসমানের যুদ্ধ হয় । অপরদিকে মোঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে শের শাহ দিল্লীর সম্রাট হন । সিলেটের শাসনকর্তা ইউসুফ খা’র ভ্রাতা লোদি খাঁ সম্রাট শের শাহের দরবারে দিল্লীতে উপস্থিত হয়ে সিলেটের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করলে, শের শাহ লোদী খাঁকে বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত করে বাংলার নাজিম ইসলাম খাঁ’র সহযোগিতার জন্য সেখানে প্রেরণ করেন ।
পরবর্তিতে নাজিম ইসলাম খাঁ’র সেনাপতি সুজাত খাঁ’র সেনা বাহিনীর কাছে খোয়াজ ওসমান পরাজিত হলে তরফ ও ইটা রাজ্য মোগলদের শাসনে আসে। বিদ্রোহ দমনের পর লদি খাঁ পুর্ণ ক্ষমতার সাথে সিলেটে মোগল শাসন পুণ্য প্রতিষ্টা করেন। লোদি খাঁ’র মৃত্যুর পর তার পুত্র জাহান খাঁ সিলেটের শাসন প্রাপ্ত হন। জাহান খাঁ সময় দিল্লীর শাসকদের মধ্যে ও পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে পর্যায়ক্রমে সম্রাট আকবর দিল্লীর সিংহাসনে উপবিষ্ট হন। সম্রাট আকবরের সময় কানুনগোদের (দেওয়ান) ক্ষমতা হ্রাস করা হয় সম্রাট আকবরের সময়ে সুবে বাংলা ১৯ টি সরকার ঘটন করা হলে সিলেট একটি সরকার রুপে গন্য হয়। সম্রাট আকবরের রাজস্ব বিভাগের মন্ত্রী রাজা তডরমাল সিলেটকে ৮টি মহালে বিভক্ত করে প্রতি মহালের রাজস্ব নির্ধারিত করেন।
সিলেট বিভাগ হতে সম্রাট আকবরের মুদ্রানুসারে সর্ব মোট ১৬৭০৪০ টাকা রাজস্ব আদায় করা হত। এছাড়া সিলেট হতে বিভিন্ন ফলমূল, বৃক্ষ ও পশু-পক্ষী বিক্রয় করে আয়কর বৃদ্ধি করে দিল্লীর মোঘল দরবারে পাঠানো হত বলে আইন-এ আকবরী গ্রন্থে বরাতে শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে উল্লেখ আছে। দিল্লী হতে নিযুক্ত আমিল বা ফৌজদারগণ রাজস্ব বিষয়ে ঢাকার নবাবের অধিনে এবং শাসন বিষয়ে মুর্শিবাদের অধিনে কাজ করতেন। ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ রাজস্বের পাকা হিসাব প্রস্তত করেন। এতে সরকার সিলেট ও এর নিকটস্থ এলাকা নিয়ে চাকলা শিলহাট (তত্কালের রেকড পত্রে উচ্চারণ) ঘটিত হয় । তত্কালে সুবে বাংলার ১৩ চাকলার মধ্যে শিলহাট দ্বাদশ স্থানীয় গণ্য ছিল ।
ত্রিপুরা রাজ্যের সরাইল (বর্তমান ব্রাহ্মণ বাড়ীয়া জেলার উপজেলা) ও ময়মনসিংহ জেলার জোয়ানশাহী প্রভৃতি প্রসিদ্ধ পরগণা চাকলা শিলহাটের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং রাজস্ব বর্ধিত করে ১৬৭০৪০ থেকে ৫৩১,৪৫৫ টাকা নির্ধারণে শ্রীহ্ট্টকে ৮ মহাল হতে ১৪৮ মহালে বিভক্ত করা হয়। মহাল গুলো পর্বতিতে ভিন্ন ভিন্ন পরগণায় খ্যাত হয়। পরবর্তিতে সুজা উদ্দীনের সময় বাংলা ২৫ টি জমিদারীতে বিভক্ত হলে সিলেটকে ২১ নং স্থানে রাখা হয়। এ সময় বিবিধ ভিন্ন ভিন্ন নামে জায়গীর ভূমি বাদে শ্রীহট্টের খালসা ভূমি ৩৬ টি পরগণাভুক্ত ছিল।
ব্রিটিশ আমল
ষোড়শ শতাব্দিতে ভারত ও পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যের উদ্দেশে একদল ব্রিটিশ বণিক একটি জয়েন্ট-স্টক কোম্পানি গঠন করে। উক্ত কোম্পানির সরকারি নাম “ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”। এ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইংলান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ কোম্পানিকে ভারতে বাণিজ্যের জন্য রাজকীয় সনদ প্রদান করেন। এ সনদের ভিত্তিতে উক্ত কোম্পানি ২১ বছর পর্যন্ত ভারতের পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করেছিল। উক্ত কোম্পানি ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাট শহরে ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে প্রথম বাণিজ্য কুঠির স্থাপনের অনুমতি পায়।
পরে তারা হুগলি সহ ভারতের অন্যান্য শহরে কুঠির স্থান করে । সপ্তদশ শতাব্দীতে (১৬৫৮ সালে) কোম্পানির প্রতিনিধি জেমস হার্ট ঢাকা শহরে অনুপ্রবেশ করলে তার মধ্য দিয়ে বাংলায় ব্রিটিশদের আগমন শুরু হয় । ১৭১৫ সালে মোঘল দরবার হতে অনুমতি পেয়ে কোম্পানির নিজেস্ব ব্রিটিশ মুদ্রার প্রচলন শুরু করে। ১৭৩২ সালে মির্জা মোহাম্মদ আলী (আলীবর্দী খাঁ) ওড়িশা, রাজমহল ও বিহারের ফৌজদার ও সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খানের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনে করেন। এ সালে সম্রাট মুহাম্মদ শাহ কর্তৃক বিহারকে বাংলার সুবাদের অন্তর্ভুক্ত করেন । এ সময় পর্যন্ত সিলেট মুঘলদের নিযুক্ত নবাবগণ দ্বারা শাসিত হতো ।
মুর্শিদাবদের ইতিহাস গ্রন্থের বরাতে অচ্যুতচরণ চৌধুরী লিখেন; সিলেটে নিযুক্ত (১৮ নং) নাবাব শমশের খাঁ’র অধীনে সীমান্ত প্রদেশ রক্ষায় আরোও ৪ জন নায়েব সিলেটের ফৌজদারীতে কাজ করতেন। ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে গিরিয়ার যুন্ধ সংঘটিত হলে শমশের খাঁ সরফরজ খাঁ’র পক্ষে সসৈন্যে উক্ত যুদ্ধে অংশ নেন এবং সরফরজ খাঁ’র সাথে তিনিও সেখানে নিহ্ত হন। এদিকে মির্জা মোহাম্মদ আলী (আলীবর্দী খাঁ) জয়োল্লাসে বঙ্গের মসনদে অধিষ্ঠিত হন। তাহার আমলে সিলেট কাছার জয়ন্তীয়া প্রভৃতি অঞ্চল মুঘলদের নিযুক্ত নবাবগণ কর্তৃক শাসিত হতো । ১৭৫১ সালে (২৯ নং) নবাব নজীব আলী খাঁ নবাবী পদ প্রাপ্ত হয়ে সিলেটের শাসন পরিচালনায় নিযুক্ত হন । তাহার আমলে সিলেটের পূর্বাঞ্চলে পাহাড়ি লোক কর্তৃক নানাহ উত্পাত সংঘটিত হয় ।
পাহাড়ি লোকদের উত্পাত বন্ধ করতে সীমান্ত রক্ষাকারী নতুন নায়েব ফৌজদার মিরাট হতে আগমন করেন এবং মোসলমান ও খ্রিস্টান গোলান্দাজ সৈন্য বুন্দাশীল নামক স্থানে অবস্থান করেন। পাহাড়িদের আক্রমণ টেকাতে সিলেটের বদরপুরে এক বৃহত্ত দুর্গ প্রস্তত করা হয়েছিল। যা আজও বদরপুরের কেল্লা হিসেবে পরিচিত হচ্ছে । পরবর্তিকালে ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল বাংলার স্বাধীন নবাব শাহ কুলি খান মির্জা মোহাম্মদ হায়বৎ জং বাহাদুর (সিরাজউদ্দৌলা) বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হন, তখন (৩০ নং) নবাব শাহ মতজঙ্গ নোয়াজিস মোহাম্মদ খাঁ সিলেট নবাবি পদ প্রাপ্ত হন। ১৭৫৭ সালে মীর জাফর আলী খাঁ, রায়দুর্লভ ও জগতশেঠ গং দের চক্রান্তে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ্দৌলা বঙ্গের নদীয়া জেলার আম বাগানে ইংরেজদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত হন। সাথে সাথে বাংলার স্বাধীনতার সুর্য অস্তমিত হয়। সিরাজ উদ্দৌলার পতনের পর বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর বাঙ্গাল সুবাদার হিসেবে স্বীকৃত হয়।
পরবর্তিকালে তার উপর ইংরেজরা অসন্তুষ্ট হয়ে মীর কাসেমকে স্থলবর্তি করে। উল্লেখ যে, সিলেট সুলতানী আমল থেকে চুণা ব্যবসায় প্রসিদ্ধ ছিল । মীর কাসেমের আমলে ইংরেজরা সিলেট অনুপ্রবেশ করে এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চুণা ব্যবসা করার জন্য মীর কাসেম কে দিয়ে সন্ধি করে । ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ২৭ সেপ্টেম্বর মীর কাসেমের সাপক্ষে সিলেটে চুণা সরবরাহের সন্ধি করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজন চুণা সরবরাহের অজুহাতে সিলেটের মানুষের উপর অমানবিক উৎপিড়ন চালাতে থাকে । মীর কাসেম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে সিলেট সহ বাংলার মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। ইংরেজরা মীর কাসেমকে তাদের বিপক্ষে দেখে মীর জাফরকে বাংলার মসনদে পুনস্থাপন করে ১৭৬৩ সালের ১০ ই জুলাই সিলেটের চুণা ব্যবসা ব্যপ্তি জন্য ৫ ম দফায় নতুন সন্ধি পত্র প্রণয়ন করে ।
এই সন্ধি পত্র মোতাবেক ইংরেজরা চুণার আয়করের অর্ধেক মালিক হইয়া পড়ে এবং অপরার্ধেক সরকারের ব্যবহারের জন্য রয়ে যায় । এ বাভেই মীর জাফরের সহযোগিতায় একটি একটি করে দেশীয় রাজ্য ইংরেজদের দখলে আসে। ১৭৬৫ সালে ইংরেজরা বঙ্গ বিহার ও উড়িষার দেওয়ানী লাভ করায় সিলেটও তাদের দখল আসে । এ সময় (জয়ন্তীয়া ও লাউড় রাজ্য ব্যতিত) সিলেটের নবাবদের অধিকৃত ভূভাগের পরিমাণ ছিল ২৮৬১ বর্গমাইল । ইংরেজ কোম্পানী ২৮৬১ বর্গমাইল ভূভাগের শুধু মাত্র রাজস্ব আদায়ে নিযুক্ত ছিল। শাসন ভার বা ফৌজদারী ক্ষমতা তখন নবাবগণের হাতেই ন্যস্ত ছিল [৬] ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হিস্টিংস ভারতে ২৫০ টি মত জেলা সৃষ্টি করেন । তখন সিলেটকেও জেলায় রুপান্তর করা হয়। পূর্ব বঙ্গের রাজস্ব সংগ্রহ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কর্ম নির্বাহের জন্য ঢাকায় রেডিনিউ বোর্ড প্রতিষ্ঠিত করা হয় ।
সেই বোর্ড হতে মিস্টার থেকার (Thecker) সর্বোচ্চ কর্মচারী রুপে সিলেটে প্রথম আগমন করেন । তখনকার সময় ইংরেজ কর্মচারী দিগকে রেসিডেন্ট উপাদিতে আখ্যায়িত করা হতো । থেকারের সময় জয়ন্তীয়ার রাজা ছত্রসিংহ সিলেটের ব্রিটিশ প্রজাদিগকে নিপিড়িত করতেন । যে কারণ থেকারের আদেশানুসারে মেজর হেনিকার কর্তৃক পরিচালিত ব্রিটিশ সৈন্য জয়ন্তীয়া জয়ে সমর্থ হয় । এ ভাবে জয়ন্তীয়া কাছার ইত্যাদি রাজ্য সমুহ ব্রিটিশ শাসনের আওতায় সিলেটের কালেক্টরীর অন্তর্ভুক্ত হলে সিলেটের ভূভাগের আয়তন ৩৮০০ বর্গমাইলে গিয়ে দাঁড়ায় ।১৭৮০ সালে থেকার চলে গেলে রবার্ট লিন্ডসে নামক এক ইংরেজ কাউন্সিলার সিলেটের কালেক্ট হয়ে আসেন। এখানে এসে নিন্ডসে সিলেটের সম্পদের প্রতি ধারণা লাভ হয়।
তাই তিনি ব্যক্তিগত তবিল থেকে এখানে প্রচুর টাকা বিনোয়গ করে বিভিন্ন জাতীয় ব্যবসা যেমন, চুনাপাথর, লবন, হাতির চামরা, জাহাজ তৈরি ও বিক্রি ইত্যাদিতে আত্মনিয়োগ করেন। অফিসের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময়টুকু ব্যবসায় ব্যয় করে লিন্ডসে অগাধ অর্থ উপার্জন করেন। এ সময় সিলেটের লোক সংখ্যা ছিল ১ লাখ। আর রাজ্যস্য ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার। লিন্ডসে আত্মজীবনি গ্রন্থের বরাতে অচ্যুত চরণ চৌধুরী সহ অনেক ঐতিহাসিকগণ লিখেনঃ এ প্রদেশের দায়িত্ব লাভ ও বেশি দিন থাকার জন্য লিন্ডসে ইংরেজ কোম্পানির উর্ধতম কর্ম-কর্তাদেরকে বহু উত্কুচ দিয়েছেন এবং এখানের রাজস্ব বিষয়ে কোম্পানির কাছে তিনি তার নিজ তবিল থেকেও সময় মত রাজস্ব আদায় করে যোগ্যতা প্রমাণ করতেন ।
এভাবে তিনি প্রচুরটাকা উপার্জন করে লর্ড শ্রেণীতে উন্নিত হন। কিন্তু তিনি সিলেটবাসীর উন্নয়নের জন্যে সামান্যতম অবদান রাখেনি । ১৭৮১ সালে সিলেটে প্রলয়ঙ্করী বন্যার পানি ৩০ ফুট উঁচু হয়েছিল বলে রবার্ট লিন্ডসে তার জীবনিতে উল্লেখ করেন। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানি দুর্গত্য মানুষের রাক্ষার্তে কোন উদ্যোগ নেয়নি। লিন্ডসেও তার দায়দায়িত্ব অবলিলায় এড়িয়ে যান। এ সময় দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে কোম্পানির অবহেলায় সিলেটের হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। যার ফলে ইংরেজ শাসনকে মানুষ সহজ ভাবে মেনে নিইতে পারেনি । ভেতরে ভেতরে মানুষের মনে বিদ্রোহ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। ১৭৮৯ সালে লিণ্ডসে সিলেট থেকে চলে গেলে তার স্থানে জন উইলিস সিলেটের কালেক্ট নিযুক্ত হন ।
উইলিস সিলেট আসিয় প্রায় লক্ষ টাকা ব্যয়ে সিলেটের জেল নির্মাণ করেন । ১৭৮৯ সালের জুলাই মাসে জন উইলিস সমগ্র সিলেটের লোক সংখ্যা গণনা করে । তাতে সিলেটের অধিবাসী সংখ্যা ৪৯২৯৪৫ এ দাড়ায় । ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানির শাসন চলেছিল মূলত এবং মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতিপদ্ধতিতেই। আর ইংরেজ আয়করের অর্ধেক মালিক হয়ে পড়ে এবং অপরার্ধেক সরকারের ব্যবহারের জন্য রয়ে যায় । দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভর করার কার্যক্রম শুরু হয়।
ব্রিটিশ সরকার এক চার্টার অ্যাক্ট বলে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার বিলুপ্ত করে এবং দেশের শাসনভার কোম্পানির উপর ন্যস্ত করে। এতে নবাবগণ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন । এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। রাজস্ব আদায়ের সুবিদা জন্য সিলেটে ১০ টি কেন্দ্র বা কালেক্টরী বিভাগ স্থাপিত করা হয়। এ কেন্দ্র গুলোর মধ্যে উত্তর শ্রীহট্টে ছিল; পারকুল, তাজপুর ও জয়ন্তীয়াপুর এই তিনটি । করিমগঞ্জে; লাতু এবং দহ্মিণ শ্রীহট্টে; নয়াখালি, রাজনগর ও হিঙ্গাজিয়া । হবিগঞ্জেঃ নবীগঞ্জ, লস্করপুর ও শঙ্করপাশা এবং সুনামগঞ্জের কালেক্টরী বিভাগ ছিল রসুলগঞ্জ । তখন সিলেটে নবাবি আমলের নির্দিষ্ট ১৬৪ পরগণা ছিল ।
১৭৯৩ সালে উইলিস সিলেট ত্যাগ করেন। জন উইলিস’র পর ১৭৯৪ সালে রেইট ও জর্জ ইংলিস নামক দুই ব্যক্তি মিলিত হয়ে বর্তমান ছাতক শহরে রেইট ইংলিস এণ্ড কোম্পানী নামে যৌথ কারবার স্থাপন করে চুনা ব্যবসা শুরু করে। এই কোম্পানীর অভ্যুদয়ের পুর্বে ছাতক একটি সামান্য গ্রাম ছিল। তত্পুর্বে একজন সন্ন্যাসী ভূমীতে একটি ছাতি পোথিয়া তার ছায়ায় বসে তপ করতেন। সন্যাসীকে কেন্দ্র করে লোক আগমন ঘটলে, ক্রমে এই স্থান ক্ষুদ্র হাটে পরিণত হয়। কালক্রমে ছত্রক বা ছাতক বাজার আখ্যা হয়েছে [৬] । এই ছাতক বাজারকে কেন্দ্র করে ইংলিস এণ্ড কোম্পানী পূর্ণ উদ্যমে চুনার ব্যবসা চালিয়ে যায়।
কোম্পানী চুক্তির করে লোকদের দিয়ে চুনা সংগ্রহ করে কলিকাতায় চালান করত। ১৭৯৭ সালে জন অমুটি নামের কালেক্টর সিলেট আসেন। অমুটির সময় সিলেটে ইট দিয়ে তিন কোঠা বিশিষ্ট এক দালান তৈরি করেন। এ দালানে যতাক্রমে এক কোঠায় সরকারী কাজপত্র সংরক্ষন করা হত, অন্য কোঠায় কর্মচারীদের অফিস ও আরেকটিতে ছিল বিচারালয়। ১৭৯৮ সালের প্রারম্ভে বিভিন্ন প্র্যোজনিয় বস্তুর দাম বৃদ্ধি হলে উত্কৃষ্ট চালের মণ বার আনায় দাড়ায়। এমনি অবস্থায় ১৮০০ সালে সিলেট শহরে বসানো গৃহ কর । একদিকে দ্রাব্যাদির মুল্যবৃদ্ধি এর মধ্যে গৃহ কর বসানোর কারণ মানুষে কষ্ট বেড়ে যায়।
১৮০৩ সালে অমুটি বিদায় হলেন অস্থায়ী কালেক্টরদের আগমনের কারণ সিলেটবাসীর অভাব-অভিযোগের অগ্রগতি থেমে যায়। ১৮০৭ – ১২ সালে অনেক নতুন আবাদি ভূমী বন্দোবস্ত দেয়া হয় । এ বন্দোবস্তই ‘তালুক’ হালাবাদি মুমাদি ইত্যাদি নামে অভহিত হয়। ১৮১১ সালে গৃহ কর নিয়ে নানা ভাবে উত্পিড়িত হন সিলেটের মানুষ । এসময় বর্তমান বন্দর বাজারের নিকট দুপুড়ি হাওয়রে উত্তর পশ্চিমে বিস্তৃত রাস্তার পাশের কিছু সংখক দোকান-পাট ছিল। গৃহ করের চাপের কারণ অনেক গুলো দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান বন্দর বাজার অনেকাংশেই জলাভুমীতে পরিণত ছিল। পরে এ স্থানে মাটি ফেলে ভরাট করা হলে পুর্বে উল্লেখিত দুপুরি হাওয়র হতে বর্তমান বাজার পর্যন্ত দোকান স্থাপন করা হয়।
যা বর্তমানে বন্দর বাজারে পরিণত হয় । ১৮২৪ সালে আসাম সম্পুর্ণ ভাবে ইংরেজদের দখলে আসে। এসময় জয়ন্তীয়ার মধ্যদিয়ে আসামে যাত্রা পথ ছিল । কিন্তু ব্রহ্ম যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ায় এটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন আসামে যাতায়ত সুবিদার জন্য পাণ্ডুয়া চেরাপুঞ্জি হয়ে শিলং পর্যন্ত নতুন রাস্তা প্রস্তত করা হয় ।
স্বাধীনতা আন্দোলন
ইংরেজদের অত্যাচার নিপিড়নে অতিষ্ঠ কিছু সংখক মুসলমান নেতৃবৃন্দের চেষ্টায় ১৭৮২ সালের মহররম মাসে মুসলমানদের ধর্মীয় উত্সবের দিনকে কেন্দ্র করে ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ইংরেজ অনুরক্ত কয়েকজন লোক লিন্ডসের কাছে এ গোপন পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেয়। যার ফলে লিন্ডসে পরিস্তিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। এদিকে মুসলমানরা ধর্মীয় কাজ সম্পূর্ণ করে যখন বিদ্রোহের ঘোষণা করেন, সাথে সাথে ইংরেজরা ঝাপিয়ে পড়ে বিদ্রোহিদের উপর। ইংরেজ বাহিনীর হাতে পিস্তল আর বন্দুক, মুসলমান বিদ্রোহিদের হাতে তলোয়ার ।
এদিনের লড়াই প্রচণ্ড রুপ ধারণ করলো এতে ইংরেজদের গুলিতে শহীদ হলেন সৈয়দ হাদি ও সৈয়দ মাদি সহ আরো অনেক। সিলেটের এ বিদ্রোহকে ভারতে ইংরেজ বিরোধী প্রথম বিদ্রোহ বলে ঐতিহাসিক তাজুল মোহাম্মদ সহ আরো অনেকে লিখেছেন।
১৭৮১ ও ১৭৮৪ সালে পরপর দুটি বিষম বন্যায় সমৃদ্ধপূর্ণ সিলেট ভূমী দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়। একদিকে ইংরেজদের লুটরাজ ও উল্লেখিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ বিষম অন্য অভাব দেখা দেয়। সিলেটের তদানিন্তন কালেক্টর লিন্ডসে তার আত্মজীবনিতে লিখেছেন; উল্লেখিত করাল দুর্ভিক্ষ হতে মুক্তি পেতে এ অঞ্চল হতে যে ধান বিক্রয়ের জন্য কলিকাতায় পাঠানো হয়েছিল, তা পুনরায়ন করিতে নৌকা পাঠিয়ে ছিলেন। তাতে কিয়দাংশ ধানই আনতে পেড়েছেন।
ইংরেজ দুশ্যাসন ও দুর্যোগে পতিত সিলেটবাসী ধীরে ধীরে ক্ষুব্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরোদ্ধে বিদ্রোহে ঘোষণা করে। ১৭৮২ তে সংঘটিত হয় খাসিয়া বিদ্রোহ, ১৭৮৬ সালে চরগোল্লায় বিদ্রোহ, ১৭৯০ সালে জমিদারদের সাথে বিদ্রোহ । উল্লেখ্য যে, তাজুল মোহাম্মদ সহ অনেক ঐতিহাসিকদের মতে উভয় বাংলার ফকির সন্ন্যাসী সংঘটিত হয়ে ১৭৬৩ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সুচনা করছিলো, তারই ধারাবাহিকতায় জনশক্তি বাড়ানোর নিমিত্তে অলিদের মাজার সহ বিভিন্ন মন্দির ও আখরায় ফকির সন্ন্যাসীরা দল বেঁধে ঘুরা-ফেরা করতেন। তারা বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করতেন এবং হাতে লাঠি ও ত্রিশুল বহন করতেন । ব্রিটিশ কোম্পানীর শাসকরা ফকির সন্ন্যাসীদের এধরনের চলা-ফেরা সংন্দেহের চোখে দেখত।
তাই ১৭৭৩ সালের ২১ জানুয়ারি ভারতের বড়লাট ওয়ারেন্ট হেষ্টিংস ফকির সন্ন্যাসীর লাঠি ত্রিশুলসহ ভ্রমণ এবং চাঁদা ও বিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যার ফলে ফকির সন্ন্যাসীরা একপর্যায়ে বিদ্রোহে মেতেউঠেন। অনেক হতাহতির পর ১৮০০ সালের দিগে ভারত বর্ষের ঐতিহাসিক ফকির সন্ন্যাসীর এ আন্দোলন প্রায় স্তিমিত হয়ে আসে। তখন সিলেটে আগা মোহাম্মদ বেগ এর নেতৃত্বে ফকির সন্যাসীরা উত্তপ্ত হয়ে উঠেন। আগা মোহাম্মদ বেগ ১৭৯৯ সালে কাছার হতে ১২’শ ফকির সন্যাসীসৈন্য সহ সিলেটে প্রবেশ করেন।
সাথে সাথে এখানকার জমিন্দারগণ তাকে সমর্থন জানিয়ে ইংরেজকে খাজানা প্রদান বন্ধ করে দেন । ফলশ্রুতিতে ইংরেজরা বিন্দাশায় আগা মোহাম্মদ বেগ এর আস্তানা আক্রন করে প্রথমে পারাজিত হয় । পরবর্তিতে ব্রিটিশ ভারতের রাজকীয় বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য পাঠানো হলে, ওদের সাথে যুদ্ধে আগা মোহাম্মদের বাহিনী পেরে ওঠেনি । ফলে প্রাণ দিতে হয় হাজারও সৈন্যকে। এদিকে আগা মোহাম্মদ বেগ উপায়ন্তর না দেখে ত্রিপুরার দিকে পালিয়ে যাওয়ার পথে ইংরেজদের হাতে বন্দি হন এবং ধরা পড়েন তার অনুসারী খাকীশাহ, রামপুর শাহ, নাজির শাহ ও রহিম শাহ সহ অনেক । ইংরেজরা আগা মোহাম্মদ বেগ বিচার ঢাকায় না করে কলিকাতায় নিয়ে যায় এবং যাবতজীবনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।
১৭৮৬ সালে নভেম্বর মাসে প্রতাপগড়ের জমিদার রাধারাম ব্রিটিশ কোম্পানিকে রাজস্ব দিতে অস্বীকার করে নিজেকে স্বাধীন নবাব ঘোষণা করে চরগোল্লায় বিদ্রোহ করেন। রাধারামের কুকি সৈন্যবাহিনীর বিরোদ্ধে রবার্ট নিন্ডসে ডেভিডসনের নেতৃত্বে সৈন্য প্রেরিত হয় । খবর পেয়ে রাধরাম তার বাহিনী নিয়ে ঐতিহাসিক শন বিলের পাড়ে ঘাটি স্থাপন করেন। ঐতিহাসিক সৈয়দ মুর্তাজা আলী শনবিল সম্পর্কে লিখেছেন; তখনকার সময়ে শনবিল ছিল অপ্রসর, সুর্দীঘ ও গভীর তরঙ্গসংকুল। এই শনবিল সম্পর্কে প্রবাদ ছিল, শনবিলে নড়ে চড়ে, রাতায় পরান মারে। শন বিলের উত্তরাংশকে রাতা বিল বলা হয়। ইংরেজ সৈন্যরা শন বিল দিয়ে রাধারামকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে এবং নৌকা যোগে সৈন্য বাহিনী নিয়ে শন বিল দিয়ে যাত্রা শুরু করে।
ইংরেজরা গোলা-বারুদ ও কামান দিয়ে নৌকা থেকেই শন বিলের তীরে অবস্থানরত রাধারামের সৈন্যবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। একদিকে শন বিলের তরঙ্গময় স্রোত আর অন্যদিকে রাধারামবাহিনীর তীর-ধনুকের আঘাতে ইংরেজ বাহিনী আর তীরে ভিড়তে না পেরে প্রাণ হারায়। পরবর্তিতে ইংরেজরা রাধারামের বন্ধু কানুরামের সহযোগিতায় চরগোলার গোপন স্থল পথের সন্ধায় পেয়ে সে পথ ধরে আবার চরগোল্লায় আক্রমণ করে রাধারামকে বন্দী করে এবং বাড়ি ঘর পুড়িয়ে ভস্ম করে চরগোল্লা জয় করে ।
১৮২৬ সালে কুকিদের সরদার বুন্তাই’র নেতৃত্বে কুকিরা এবং ১৮২৭ সালে সিলেটের পাণ্ডুয়ায় খাসিয়ারা বিদ্রোহ করে । ১৮৫৭ সালে সিপাই বিদ্রোহ নামের ভারত ব্যাপী বিষম বিদ্রোহ ঘটিত হয়। এ বিদ্রোহের একটি স্ফুলিঙ্গ সিলেটে ইংরেজদের বিদগ্ধ করতে ধাবিত হলে সিলেটে সংঘটিত সিপাই যুদ্ধ। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে দেশীয় সৈন্য বাহিনী যখন বিদ্রোহ ঘোষণা কর, এ সময় চট্টগ্রামের ৩৩ নং সীমান্ত রক্ষী ও পদাতক বাহিনী চট্টগ্রামের অস্ত্রগার ও ট্রেজারী লুট করে এবং জেলখানার বন্ধি মুক্তি করে তারা পালিয়ে আসে সিলেটের দিকে। ত্রিপুরা পার হয়ে সিলেট প্রবেশ করলে সিলেটের মৌলভীবাজার অঞ্চলের পৃথিমপাশার জমিদার গউছ আলী খান তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে পাহাড়ি অঞ্চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
অন্যদিকে ইংরেজ প্রেরিত এক বিরাট বাহিনী বিদ্রোহী সিপাইদের গতিরোধ করতে প্রতাপগরের দিকে অগ্রসর হয় । চট্টগ্রাম হতে আগত সৈন্য সহ তিনশ’র ও বেশি স্বদেশী বাহিনী ইংরেজদের মোকাবেলা করতে বড়লেখা থানার পাশে লাতু নামক স্থানে অবস্থান নেয় এবং এ লাতু অঞ্চলে বিদ্রোহী সিপাইদের সাথে ইংরেজ বাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধ হয় । তখন বিদ্রোহী সিপাইদের গুলিতে ইংরেজ সেনাপতি মিষ্টার বিং সহ আরো অনেক ইংরেজ সৈন্য নিহত হয় । এ যুদ্ধ ৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল । শহীদ হন অনেক দেশীয় সিপাই । অবশেষে ইংরেজ বাহিনী সুবেদার অযোধ্যা নামক যোদ্ধার রণ কৌশলে বিদ্রোহী সিপাইদের অনেক জন আহত হলে বাকিরা পালয়ন করেন । এরপর ইংরেজরা বিভিন্ন স্থানে ধাওয়া করে পলাতক সিপাইদের নিহত ও বন্দি করে সিপাই বিদ্রোহ দমন করে।
১৮৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আসাম প্রদেশ গঠিত হয়। তখন আসামের ব্যয়ের তুলনায় আয় ছিল নগণ্য। স্থায়ী প্রশাসন পরিচালনায় শিক্ষিত লোকও অভাব ছিল । সিলেট জেলায় লোক বসতি অপেক্ষাকৃত ঘন ছিল। এখানকার লোক শিক্ষাদীক্ষায়ও অগ্রসর ছিল। সিলেটের নিম্নাঞ্চলে ধান ফসলে ভাণ্ডার ছিল । এছাড়া এ অঞ্চলে কয়লা, পাথর ও চুনা প্রভৃতি হতে আয় ছিল প্রচুর । তাই সিলেটের লোকবল ও সম্পদের আয়কে কাজে লাগিয়ে আসামকে উন্নত করতে এ জেলাকে আসামের সাথে সংযুক্ত করতে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা জারি করে। সিলেট বাংলার অংশ, তাই সিলেটবাসী বাংলার সাথেই থাকতে চায়।
তাই তারা সরকারের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন । প্রশাসন সিলেটবাসীর তিব্র প্রতিবাদে সিলেটকে আসামের সাথে সংযুক্ত করতে ব্যর্থ হয় । তখন ব্রিটিশ ভারতের বড় লাট নর্থব্রুক সিলেটে আসেন । সিলেটের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বড় লাটের সাথে সাক্ষাত করে আসামে যুক্ত করার প্রতিবাদলিপি পেশ করেন। বড় লাট নর্থব্রুক সিলেটে ডিপুটি প্রশাসন সৃষ্টি করে সিলেটের উন্নয়ন গতিশীল রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে নতুন প্রস্তাবের ভিত্তিতে সিলেটকে আসামে যুক্ত করেন।
বঙ্গভঙ্গ ও রাজনৈতিক আন্দোলন
১৮৮৫ সালে থিওজোফিক্যাল সোসাইটির কিছু সদস্য কংগ্রেস প্রতিষ্টিত করলে গণ-আন্দোলনের শুরু হয়। এ সময় সিলেট অঞ্চল থেকে বিপিন চন্দ্র পাল বোম্বের কংগ্রেসে যোগদান করতঃ আন্দোলনে সিলেটবাসীর পক্ষে অবদান রাখেন। ১৯০৫ সালে ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে প্রথম পশ্চিমবঙ্গ (ভারতীয় বঙ্গ) অঞ্চলটিকে পূর্ববঙ্গ থেকে পৃথক করা হয়। হিন্দুরা পশ্চিম বঙ্গ ও মুসলমানরা পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পশ্চিম বঙ্গ হতে ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হয়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব্বঙ্গের মুসলমানরা বিভাগিয় শাসন প্রতিষ্টার আশায় যখন ঢাকায় নতুন নতুন অট্টালিকা যেমন, বিচার বিভাগ, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট ও আইন পরিষদ প্রভৃতি নির্মাণে উজ্জীবিত, তখনই এর বিরুদ্ধে প্রশ্চিম বঙ্গ হতে ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
জাতীয়তাবাদি হিন্দু নেতৃবৃন্দ একে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অনৈক্য এবং মাতৃভূমী বিভক্তিকরণ ইত্যাদি আখ্যায়িত করে তিব্র আন্দোলন আরম্ভ করেন। ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় এবং সিলেটকে আবার আসামে সংযুক্ত করা হয়। বঙ্গভঙ্গের পর থেকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ সম্মেলিত ভাবে যখন ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে ঝাপিয়ে পরেন । এ সময় সিলেটবাসীও রাজনীতির সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। বিভিন্ন সময়ে সিলেটের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ খেলাফত আন্দোলন, কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে সিলটবাসীর পক্ষে অবদান রাখেন। সিলেট শহরে বিভিন্ন সময় অনুষ্টিত হয়েছে রাজনৈতিক সম্মিলন।
বালাগঞ্জের আরঙ্গপুর গ্রামে ১৯১৮ সালে অনুষ্টিত উলামা সম্মেলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন মৌলানা আব্দুল হক চৌধুরী, সৈয়দ আফরুজ বখত। ১৯২০ সালে ২২ ডিসেম্বর সর্বভারতীয় কংগ্রেস ও খেলাফত সম্মিলন অনুষ্টিত হয় ভারতের নাগপুরে । সিলেট থেকে মুসলিমলীগের প্রতিনিধি মৌলানা আব্দুর রহমান সিংকাপনী অনেকজন সহকর্মি নিয়ে উক্ত সম্মিলনে অংশগ্রহণ করে ছিলেন। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ খেলাফত কমিটির আমন্ত্রনে সিলেটের শাহী ঈদগাহ মাঠে অনুষ্টিত সমাবেশে যোগ দিয়েছেন ।
১৯৩২ সালে সুরমাভ্যালি কৃষক সম্মিলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন শাহ ইসমাইল আলী। ১৯২১ সালে দু-দিন ব্যাপী মৌলভীবাজারে অনুষ্টিত হয় ভারতীয় খেলাফত সম্মিলন। এ সম্মিলনে ভারত খেলাফত আনন্দোলনের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভারত হতে আসেন প্রখ্যাত ইসলামিক চিন্তাবিদ মৌলানা হুসেন আহমদ মদনী ও সরোজিনী নাইডু। সমাবেশের আয়োজক ও অভ্যর্থনা কমিটির প্রথম কাতারের নেতৃবৃন্দ ছিলেন; মৌলানা নাজির উদ্দীন, মৌলানা আব্দুর রহমান সিংকাপনী, ডঃ মুর্তজা চৌধুরী, মৌলানা আব্দুল্লা বি, এল ও সৈয়দ আব্দুস সালাম। ১৯২৭ সালে সিলেটের বর্তমান শারদা হলে অনুষ্টিত হয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন সম্মিলন। এ সম্মিলনের অথিতিবৃন্দ ছিলেন বিদ্রোহ কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও বেগম যুবেদা খাতুন চৌধুরী।
এভাবে সিলেটবাসীর উত্সাহে আমন্ত্রীত হয়ে বিভিন্ন সময় ভারতে ব্রিটিশ বিরুধী আন্দোলনের প্রথম কাতারের নেতৃবৃন্দ সিলেট এসেছেন এবং সিলেটবাসীকে আন্দোলের জন্য উত্সাহিত করেছেন। ১৯৩৬ সালে সিলেটের সুনামগঞ্জে সংঘটিত হয় কৃষক আন্দোলন। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সর্বগ্রাসী সংগ্রামে ফলে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ১৯৩৭ সালে বাংলাসহ বিভিন্ন প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্টিত হয় । হিন্দু প্রধান প্রদেশ গুলোতে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠন করে । ১৯৩৭ সালে জিন্নাহ ঘোষণা করেন ভারতবর্ষে জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্টা করতে মুসলিমলীগ সবিশেষ আগ্রহী। রাজনৈতিক পটভূমিকায় লৌঙ্হ্মনতে মুসলিমলীগের অধিবেশন হলে, এতে শেরে বাংলা ফজলুল হক উত্তাপিত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয় । লাহোর প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বে দুটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেন। মহাত্মা গান্ধী সহ জাতীয়াবাদি দল কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ এর বিরোধিতা করেন।
১৯৪২ সালে কংগ্রেস ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলন ভারত ছাড়ো (Quit India) সুচনা করে। সাথে সাথে বাংলা ও পাকিস্তানে আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে । এতে ব্রিটিশরা বাধ্য হয়ে ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে সাথে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুপ ধারণ করে । ভারত জুরে উক্ত সম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হলেও সিলেট অঞ্চল তখনঅও শান্ত ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
পাকিস্তানে অর্ন্তভুক্তি
অবেশেষে ইংরেজ বিদায়ের ঘণ্টা বেজে উঠল। ইংরেজ বিদায়ের পর্বে ভারতকে বিভক্ত করার পরিকল্পনায় পাকিস্তান সহ দুই বাংলাকে দিখণ্ডিত করা উদ্যোগ নেয়। সিলেট তখন আসাম প্রদেশের একটি জেলা থাকা সত্তেও মুসলিম প্রধান জেলা ছিল। তাই সিলেট ভারতের না পাকিস্তানে থাকবে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠে। ১৯৪৬ সালে ২৩ শে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সিলেটে আসেন । বিরাট জনসভায় মুসলমানদেরকে পাকিস্তানের পক্ষে সিন্ধান্ত গ্রহণে উত্সাহিত করে বক্তব্য রাখেন। ১৯৪৭ সালে ৩ জুন ইংরেজরা ভারত বিভক্তির ঘোষণা দেয় । ঘোষণা অনুযায়ী সিলেট মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পুর্ব্ বঙ্গের সাথে যোগ দেবে কি না তা নিয়ে গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয় ।
শুরু হয় কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের নেতৃবৃন্দের গণ সংযোগ। একদিকে কংগ্রেস নেতা বসন্ত কুমার দাস, বৈদ্যনাথ মুখার্জী, ব্রজেন্দ্র নারয়ণ চৌধুরী প্রমুখ সিলেটকে আসামের সাথে রাখার জন্য প্রাণপণ প্রচারণা চালান। অন্যদিকে নুরুল আমিন,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন, তমিজ উদ্দীন, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, দেওয়ান আব্দুল বাছিত, দেওয়ান এম মনসুর আলী, ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, জিল্লুর রহমানসহ আরো অনেক নেতৃবৃন্দ সিলেটে এসে সিলেটকে পুর্ব বঙ্গ (বাংলাদেশ) এর সাথে রাখার জন্য প্রচারণা চালাতে থাকেন ।
অবশেষে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই মাসে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় । গণভোটে কমিশনার নিযুক্ত আসামের লিগেল রিমমব্রেসার এইচ এ ষ্টর্ক এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়ীত্ব নেন ডিপুটি কমিশনার ড্রামব্রেক। সিলেটের জনগণ নির্বাচনে ৫২ হাজার ৭ শ’ ৮০ ভোটে পাকিস্তানের পক্ষে রায় দেয় । কিন্ত রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী করিমগঞ্জ মহকুমার পাথারকান্দি, রাতাবাড়ি ও বদরপুর থানা এবং করিমগঞ্জ থানার অধিকাংশ সিলেট থেকে বিচ্যুত হয়ে আসামভুক্ত হয়ে ভারতে সাথে চলে যায়।
ভাষা আন্দোলন
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয় এবং ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। এ বিভক্তির সময় বাংলার মুসলিমপ্রধান পূর্ব ভাগ পুর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় ও হিন্দু প্রধান পশ্চিম ভাগ পশ্চিমবঙ্গ নামে ভারতে চলে যায়। পাকিস্তান নামে দেশটি সৃষ্টি হওয়ার পর, তার পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বৈষম্য অব্যাহ্ত থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস। ভৌগোলিক, সংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল রাজনৈতিক দন্দ্ব। পাকিস্তান সৃষ্টি হলে প্রথমেই আঘাত করা হয় পূর্ব বাংলার ভাষার উপর ।
রাষ্ট্রের গৃহীত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৬ কোটি ৯০ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখই বাংলাভাষী এবং উর্দু সহ আরো অন্যান্য ৭টিরও বেশি ভাষায় কথা বলতো ২ কোটি ৫০ লক্ষ। অর্থাৎ জনসংখার শতকরা ৬৪ ভাগ ছিল বাংলাভাষী আর শতকরা ৩৬ ভাগ লোক অন্যান্য ভাষায় কথা বলতো। তবুও পাকিস্তানের শাসকগোষ্টি শুধু বাঙালীদের দাবিয়ে রাখার জন্য উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার সম-মর্যাদার দাবীতে শুরু হয় আন্দোলন। বাঙালী জাতীয়তাবাদি নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান গণপরিষদে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, ঢাকায়, কলকাতায় সর্বস্থানে বাংলাভাষার দাবি উত্থাপন করে, শাসক গোষ্টির রাষ্ট্রভাষা উর্দু’র প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেন, আব্দুল হক, মাহবুব জামাল জাহেদী, ফররূখ আহমদ, ডঃ কাজী মোতাহের, আবুল মনসুর, আবুল কাশেম ও ড এনামুল হক সহ আরো অনেকে । আর ঐ সময় বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় সব চেয়ে বেশি লিখা বের হয় ড মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর। বাংলাদেশের ভেতর থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা’ করার দাবি নিয়ে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে প্রথম লিখা বের হয় সিলেটের আল ইসলাহ পত্রিকায়। প্রবন্ধ লিখেন মুসলিম চৌধুরী। এ লিখার সূত্র ধরে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখে প্রকাশ্যে জনসভা অনুষ্টিত হয়েছিল সিলেটে ।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্য কোথায় বাংলা ভাষার দাবিতে কোন সভা হয়েছে বলে আর শোনা যায়নি। পরবর্তিতে ১৯৪৮ সালে ৮ মার্চে সিলেটের গোবিন্দ পার্কে সভা অনুষ্টিত হলে এতে বিঘ্নতা ঘটায় পাকিস্তান পন্থী মুসলিম লীগের সন্ত্রাসবাদি নেতারা। ১০ মার্চে সিলেটের মহীলা মুসলীম লীগ প্রতিবাদ সভার ডাক দেয়। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন তা হতে দেয়নি। তারা সিলেট শহরে দুই মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। প্রতিবাদের ফেটে পড়ে সিলেটবাসী। দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে সারা জেলায়। ধারাবাহিক আন্দোলন হয় হবিগঞ্জে, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে। ১৯৫০ সালের কোন একসময় অসম্প্রাদায়ীক ছাত্র সংগঠন গড়ার লক্ষে সিলেটের রসময় মেমোরিয়েল হাইস্কুলে এক সমাবেশ আহবান করে সংগঠন গড়ার প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়।
উক্ত কমিটির আহবায়ক চেয়ারম্যান মনোনিত হন অধ্যাপক আসদ্দর আলী, আহবায়ক সদস্য বাংলাদেশের বর্তমান অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও তারা মিয়া প্রমুখ। এ কমিটি গড়ার কিছু দিন পরেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেটে এক সরকারি সফরে এলে, তিনি এধরনের সংগঠনের জন্ম রোধ করতে স্থানীয় প্রশাসনকে কড়া নির্দেশ দিয়ে যায়। যার ফলে জেলা প্রশাসক ১৩ নভেম্বর থেকে সিলেটের সদর থানা এলাকায় দুই মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে।
এমনকি সংগঠনের উদ্যোক্তাদের উপরও ১৪৪ ধারা প্রয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়। তবুও সাবেক জেলা প্রশাসক তা দাবিয়ে রাখতে পারেননি। ১৯৫১ সালে আসদ্দর আলী, তারা মিয়া, এ এম আব্দুল মুহিত, নাসির উদ্দীন আহমদ চৌধুরী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় ১৬ নভেম্বর গোলাপগঞ্জের মৌরপুর পরগণাধীন পাঠানটুলা মাঠে জমায়েত হন সিলেটের ছাত্র নেতারা। সম্মিলনের কাজ শেষ হবার পুর্বেই ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিরাট পুলিশবাহিনী নিয়ে সম্মিলেন স্থলে উপস্থিত হয়ে সম্মিলন মাঠে ১৪৪ ধারা জারি করেণ। তখন নেতৃবৃন্দ কৌশলগত ভাবে উপস্থিত সমাবেশকারী সকলের প্রতি নামাজ আদায়ের আহবান জানান। একজন দাড়িয়ে আজান দিলেন। সকলেই অজু করে এসে জামাতবদ্ধ হয়ে নামাজ আদায় করেন।
নামজের ইমামতি করছিলেন মাওলানা শামসুল হক। তিনি নামাজ শেষে এক দীর্ঘ মোনাজাত করতে গিয়ে সমাবেশের উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করে বলেন; হে আল্লাহ আজকের এই সমাবেশে গঠিত সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়ন নামে সংগঠনকে তুমি কবুল কর। সংগঠনের মনোনিত সভাপতি আব্দুল হাই ও খন্দকার রুহুল কুদ্দুসকে সাধারণ সম্পাদক, এভাবে নেতাদের নাম ও পদবি উল্লেখ করা হয়। পুলিশের ১৪৪ ধারার মধ্য দিয়ে মোনাজাতে সর্ব বিষয় ব্যক্ত করে সংগঠনের জন্ম হয়েছে বলে ঐ দিনের মোনাজাতকে ঐতিহাসিক মোনাজাত বলে সিলেটে অভিহিত করা হয়।
পরবর্তিতে এ সংগঠনের নেতারাই ঢাকা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংগঠনগুলোর সাথে যোগসাজশ রেখে বাংলাভাষার দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যান। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির অনেক আগে থেকে সিলেট শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালে আন্দোলন শুরু হলে সাথে সাথে সিলেট শহরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শহর জনস্রোতে পরিণত হয়। বিক্ষুব্ধ সিলেটবাসী ২১শে ফেব্রুয়ারি হতে ১৫ দিন সিলেটে ধর্মঘটের ডাক দেয়। এভাবেই সিলেটবাসী ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন।
সিলেট জেলার প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর বিবরণ
খাসিয়া – খাসিয়ারা খাসিয়া ও জয়ন্তীয়া পাহাড়ে বসবাস করত । ওরা কয়লা জাতীয় দ্রব্যের বিক্রেতা ছিল । বহু কাল পরে এদের অনেকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে।
তিপরা – ওরা ছিল বোদো জাতীয় হিন্দু । তিপরাগণ বাঙ্গালী সংস্রব পেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে । পরবর্তিকালে মণিপুরিদের আচার ব্যবহার অনুসরণ করে তাদের ন্যায় বেশভূষা ধারণ করতে যত্নবান হয়েছে।
মণিপুরী – মণিপুরীগণ শ্রীহট্টের ঔপনিবেশিক জাতি। মণিপুরীরা অর্জ্জুন পুত্র বভ্রুবাহনকে তাদের আদিপুরুষ বলিয়া ক্ষত্রিয়ত্বের দাবি করে ও উপবীত ধারণ করে। শ্রীহট্ট সদর, পাথারকান্দি, জাফরগড়ের লক্ষিপুর, শিলং, লংলা, ধামাই, তরফ, আসামপারা, সুনামগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে ওদের বসবাস। বহ্মযুদ্ধের পরই মণিপুরিরা শ্রীহট্ট ও কাছাড়ে আগমন করে উপনিবেশ স্থাপন করে। মণিপুরীদের আলাদা এক কথ্য ভাষা আছে।
লালং – প্রাচীনকালে ওরা কাছাড়ের ডিমাপুর নামক অঞ্চলে বসবাস করতো। কথিত আছে; তথাকার রাজা মানবদুগ্ধ পান করতেন এবং ওদের (লালংগণ) দৈনিক ছয়সের দুধ যুগান দিতে হতো। রোজ ছয়সের দুধ যুগান অসাধ্য ভেবে, রাজার ভয়ে পালায়ন করে জয়ন্তীয়ায় এসে বসবাস করে । পরবর্তিকালে পাহাড়ি অঞ্চল পরিত্যাগ করে শ্রীহট্টের সমতল ক্ষেত্রে এসে বসবাস শুরু করে। সামাজিক দিক দিয়ে ওরা বিবাহউত্তর স্ত্রী’র বংশভুক্ত হয় এবং স্ত্রী’র মরণউত্তর নিজ বংশে গণ্য হয়।
উক্ত পার্বত্য জাতি ছাড়া শ্রীহট্ট জেলায় আরও বহু জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। যাদের মধ্যে; কামার, কুমার, কায়স্থ, কুশিয়ারী, কেওয়ালী, কৈবর্ত্ত, নমশ্রুদ্র, গণক, গাড়ওয়াল, গন্ধবণিক, গোয়াল, জেলে, চুণার, ঢোলি, তাতি, তেলী, দাস, ধোপা, নদীয়াল, নাপিত, ব্রাহ্মণ, বর্ণ-বাহ্মণ, ময়রা, যুগী, বারুই, বৈদ্য ইত্যাদি । এদের মধ্যে পার্বত্য সম্প্রদায় ব্যতিত সকলই বাঙ্গালী জাতি।
সিলেট জেলার ঐতিহ্য
সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.)
হযরত শাহজালাল (র.) ছিলেন উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত দরবেশ ও পীর। তিনি ছিলেন ওলিকুল শিরোমণি। সিলেট অঞ্চলে তার মাধ্যমেই ইসলামের প্রসার ঘটে। সিলেটের প্রথম মুসলমান শেখ বোরহান উদ্দিন (র.) এর ওপর রাজা গৌড়গোবিন্দের অত্যাচার এবং এর প্রেক্ষিতে হযরত শাহজালাল (র.) ও তাঁর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ কারণে সিলেটকে ৩৬০ আউলিয়ার দেশ বলা হয়। কেউ কেউ সিলেটকে পূণ্যভূমি অভিধায়ও অভিহিত করেন।
আরবের মাটি ও সিলেটের মাটির মিল
কথিত আছে, প্রাচ্যদেশে আসার পূর্বে শাহজালাল (র.) এর মামা মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবীর (র.) তাঁকে এক মুঠো মাটি দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্বাদে বর্ণে গন্ধে এই মাটির মতো মাটি যেখানে পাবে সেখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করবে।’
হযরত শাহজালাল (র.) বিশিষ্ট শিষ্য শেখ আলীকে এই মাটির দায়িত্বে নিয়োগ করেন এবং নির্দেশ দেন যে, যাত্রাপথে বিভিন্ন জনপদের মাটির সাথে যেন এই জনপদের মাটির তুলনা করে তিনি দেখেন। পরে এই শিষ্যের উপাধি হয় চাষণী পীর। সিলেট শহরের গোয়াইপাড়ায় তাঁর মাজার বিদ্যমান। সিলেটের মাটির সাথে আরবের মাটির মিল পাওয়ায় হযরত শাহজালাল (র.) সিলেটে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। সিলেটে তেল ও গ্যাস পাওয়ায় আরবের মাটি ও সিলেটের মাটির মিল প্রমাণিত হয়েছে।
গজার মাছ
হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার চত্বরের উত্তর দিকে একটি পুকুর রয়েছে। এ পুকুরে রয়েছে অসংখ্য গজার মাছ। এসব মাছকে পবিত্র জ্ঞান করে দর্শনার্থীরা ছোট ছোট মাছ খেতে দেয়। পুকুরের পশ্চিম কোণে ছোট মাছ বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। পুকুরে অজুর ব্যবস্থাও আছে। ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিষ প্রয়োগে পুকুরের প্রায় ৭শ’রও বেশি গজার মাছ হত্যা করা হয়। ফলে পুকুরটি গজার মাছ শূন্য হয়ে পড়ে। মরে যাওয়া মাছগুলোকে মসজিদের পশ্চিম দিকের গোরস্থানে পুঁতে ফেলা হয়। পুকুরটি মাছ শূন্য হয়ে যাওয়ার পর হযরত শাহজালাল (র.) এর অপর সফরসঙ্গী মৌলভীবাজারের শাহ মোস্তফার (র.) মাজার থেকে ২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি ২৪ টি গজার মাছ এনে পুকুরে ছাড়া হয়। বর্তমানে পুকুরের গজার মাছের সংখ্যা কয়েক শ’তে দাঁড়িয়েছে বলে জানা যায়।
জালালী কবুতর ও নিজাম উদ্দিন আউলিয়া
হযরত শাহজালাল (র.) এর আধ্যাত্নিক শক্তির পরিচয় পেয়ে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া(র.) তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ তিনি তাঁকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর বা জালালী কবুতর উপহার দেন। সিলেট ও আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায় তা ওই কপোত যুগলের বংশধর এবং জালালী কবুতর নামে খ্যাত। সিলেটে জাতিধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কেউই এ কবুতর বধ করে না এবং খায় না। বরং অধিবাসীরা এদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে থাকে। শাহজালালের (র.) মাজার এলাকায় প্রতিদিন ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর উড়তে দেখা যায়। মাজার কর্তৃপক্ষ এসব কবুতরের খাবার সরবরাহ করে থাকেন।
রাজস্বমুক্ত কসবে সিলেট
হযরত শাহজালাল (র.) ছিলেন কামনাবাসনামুক্ত নির্লোভ সূফি সাধক। কথিত আছে, দিলস্নীর সম্রাট তাঁকে নবাবী প্রদান করে একটি সনদ পাঠান। হযরত শাহজালাল (র.) তা প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, তিনি সংসারবিরাগী ফকির, তাঁর নবাবীর প্রয়োজন নেই। এক পর্যায়ে সম্রাট তাঁকে সিলেটের জায়গীর গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। হযরত শাহজালাল (র.) তাতেও রাজি হননি। শেষে সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি হযরত শাহজালালের (র.) প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে সিলেট শহরকে রাজস্বমুক্ত (কসবে) বলে ঘোষণা দেন। এ কারণে আজো সিলেট শহরের ভূমি রাজস্ব থেকে মুক্ত।
জমজমের কূপ ও ঝরণা
লোকশ্রম্নতি আছে যে হযরত শাহজালাল (র.) একটি কূপ খনন করার আদেশ দিয়ে প্রার্থনা করেন আলস্নাহ যেন এই কূপটিকে জমজমের কূপটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেন। এরপর তিনি লাঠি দিয়ে মাটির ওপর আঘাত করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে এই কূপটির সাথে জমজমের কূপের মিলন ঘটে গেল। তারপর এর চারপাশ পাকা করে দেওয়া হলো এবং উত্তর পার্শ্বে দুটি পাথর বসিয়ে দেওয়া হলো-যা থেকে দিনরাত পানি প্রবাহিত হয়।
ডেকচি
মাজারের পূর্ব দিকে একতলা ঘরের ভেতরে বড় তিনটি ডেকচি রয়েছে। এগুলো ঢাকার মীর মুরাদ দান করেছেন বলে জানা যায়। মীর মুরাদ ঢাকার হোসেনী দালান তৈরী করেন। যদিও ডেকচিগুলোতে রান্নাবান্না হয় না, তবুও কথিত আছে প্রত্যেকটিতে সাতটি গরম্নর মাংস ও সাত মণ চাল এক সাথে রান্না করা যায়। পূণ্যের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা ডেকচিগুলোতে প্রচুর টাকাপয়সা দান করেন।
চিলস্নাখানা
মাজারের দক্ষিণ দিকে গ্রীলঘেরা তারকাখচিত ছোট্ট যে ঘরটি রয়েছে, এটি হযরত শাহজালালের (র.) চিলস্নাখানা। স্থানটি মাত্র দু’ফুট চওড়া। কথিত আছে যে, হযরত শাহজালাল (র.) এই চিলস্নাখানায় জীবনের ২৩ টি বছর আরাধনায় কাটিয়েছেন।
শাহজালালের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি
হযরত শাহজালাল (র.) কেবল একজন পীর ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বীর মোজাহিদ। তার ব্যবহৃত তলোয়ার, খড়ম, প্লেট এবং বাটি দর্শনার্থীদের দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। দরগার দক্ষিণ দিকে দরগাহ মাদ্রাসা বিল্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে একটি প্রবেশ পথ রয়েছে। এই পথ দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পর বাঁ দিকের বাড়িটি মুফতি নাজিমুদ্দিন আহমদের। এই বাড়িতে হযরত শাহজালালের (র.) তলোয়ার ও খড়ম সংরক্ষিত আছে। প্লেট ও বাটি সংরক্ষিত আছে দরগাহ’র মোতওয়ালিস্নর বাড়িতে। এগুলো দেখতে প্রতিদিন উৎসুক মানুষের ভীড় জমে।
দরগাহ মসজিদ
বাংলার সুলতান আবু মুজাফ্ফর ইউসুফ শাহের মন্ত্রী মজলিশে আতার আমলে ১৪০০ সালে দরগাহ চত্বরে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। ১৭৪৪ সালে বাহরাম খাঁ ফৌজদারের সময় এটি পুনর্নির্মিত হয়। বর্তমানে এটি সিলেট শহরের অন্যতম একটি মসজিদ।
হযরত শাহজালালের (র.) সিলেট আগমন
হযরত শাহজালাল (র.) আরবের ইয়েমেনের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতা মাহমুদ বিন মোহাম্মদ ছিলেন কোরায়শ বংশের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁকে পীরদের পীর হিসেবে অভিহিত করা হতো। তিনি বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন। তাঁর মা ছিলেন সৈয়দ বংশের এক মহীয়সী নারী। শাহজালালের (র.) বয়স তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। মায়ের মৃত্যুরপর মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দী তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে লালনপালন করেন। তিনি ভাগ্নেকে এমনভাবে বড় করতে চান যাতে তিনি পা–ত্য ও বৈদগ্ধের স্তরে গিয়ে পৌঁছে যেতে পারেন। ধীরে ধীরে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ পেতে থাকে।
কথিত রয়েছে, একদিন সৈয়দ আহমদ কবির তাঁর নিজ গৃহের ভেতর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে এসে হযরত শাহজালালের (র.) হাতে দিয়ে বললেন, ভারতবর্ষের দিকে বেরিয়ে পড়ো এবং যে মাটির সাথে এ মাটির রূপ-রস-ঘ্রাণের সাদৃশ্য খুঁজে পাবে সেখানে এই মাটি ছড়িয়ে দিয়ে আস্তানা গাড়বে। শাহজালাল (র.) তাঁর পীরের কথা অনুযায়ী হাজী ইউসুফ ও হাজী খলিলসহ আরো কিছু শিষ্য নিয়ে ভারতবর্ষের দিকে রওয়ানা হলেন। প্রথমে তিনি নিজ বাসভূমি ইয়েমেনে এসে পৌঁছেন। এসময় ইয়েমেনে এক অত্যাচারী রাজা ছিলেন। তিনি বিষপানে হযরত শাহজালালকে (র.) বধ করার চেষ্টা চালান। কিন্তু হযরত শাহজালালের (র.) কৌশলের কাছে রাজার দুরভিসন্ধি পরাজিত হয়। রাজার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শেখ আলি ক্ষমতায় অভিষিক্ত হন।
শেখ আলি হযরত শাহজালালের (র.) গুণ ও কোমলমতির পরিচয় পেয়ে তাঁর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি হযরত শাহজালালের (র.) সফরসঙ্গী হলেন। হযরত শাহজালাল (র.) তাঁর পীরের দেওয়া মাটি শেখ আলির হাতে দিয়ে বললেন, আমরা যখন যেখানে গিয়ে পৌঁছাব, সেখানকার মাটির সঙ্গে এ মাটির রূপ-রস-গন্ধ তোমাকে মিলিয়ে দেখতে হবে- এটাই হল তোমার কাজ। শেখ আলিকে জিহবা দিয়ে চুষে মাটি নিরীক্ষণ করতে হতো। সে কারণে আজো তাঁকে চাষণির পীর হিসেবে অভিহিত করা হয়।
হযরত শাহজালাল (র.) যখন দিলস্নীতে পৌঁছান, তখন সেখানকার বিখ্যাত পীর ছিলেন নিজাম উদ্দিন আউলিয়া। তিনি প্রকৃত অর্থেই অনুধাবন করতে পারলেন হযরত শাহজালাল (র.) একজন দরবেশ। তিনি ছাই রঙের এক জোড়া কবুতর উপহার হিসেবে পাঠিয়ে তাঁকে তার দরবারে নিমন্ত্রণ জানালেন। হযরত শাহজালাল (র.) যখন সিলেটে আসেন-তখন এখানে গোবিন্দ নামক এক রাজার রাজত্ব ছিল। এ রাজ্য জাদুটোনার জন্য বিখ্যাত ছিল। রাজা গোবিন্দের জন্মস্থান গৌড়ে থাকায় তাকে গৌড়গোবিন্দ নামে ডাকা হতো। হযরত শাহজালাল (র.) ও তাঁর সঙ্গীরা যখন গৌড় রাজ্য অধিকার করেন-তখন রাজা গৌড় ছেড়ে সিলেটে আশ্রয় নেন এবং নিজেকে রাজা বলে দাবি করতে থাকেন। ওই সময় সিলেট শহরের পূর্ব দিকে অবস্থিত টুলটিকর নামক স্থানে শেখ বোরহান উদ্দিন নামক একজন মুসলমান থাকতেন।
বোরহান উদ্দিন ছিলেন নিঃসন্তান। আল্লাহর কাছে অনেক প্রার্থনার পর তিনি একটি পুত্র সন্তান লাভ করলেন। তাঁর সন্তানের আকিকা উপলক্ষে তিনি একটি গরু কুরবানি দেন। এসময় একটি কাক অথবা একটি চিল এক টুকরো মাংস তুলে নিয়ে গৌড়গোবিন্দের গৃহপ্রাঙ্গণে ফেলে দিল। কুসংস্কার আশ্রিত রাজা ভীষণ রাগান্বিত হলেন। তিনি বোরহান উদ্দিনকে ডেকে নিয়ে তাঁর হাতের কব্জি কেটে দিলেন এবং তার নিষ্পাপ শিশুকে জবাই করে হত্যা করলেন। এতে বোরহান উদ্দিন নিরূপায় হয়ে পড়লেন। তাঁর মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে। একদিন বোরহান উদ্দিন গোপনে শহর ছেড়ে দিলস্নীর সুলতান আলাউদ্দিন ইবনে মাহমুদ শাহের দরবারে গিয়ে হাজির হলেন।
তিনি সুলতানের কাছে তাঁর ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করলেন। সুলতান এ মর্ম পীড়াদায়ক কাহিনী শুনে ভীষণ আঘাত পেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বোরহান উদ্দিনের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাঁর ভাতিজা সিকন্দর শাহকে সসৈন্যে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সিকন্দর গাজি ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে সোনারগাঁয়ে আস্তানা গাঁড়লেন। খবর পেয়ে গৌড়গোবিন্দ তার জাদুকরদের ভৌতিক শক্তির সাহায্যে সিকন্দর গাজির সৈন্যদের ওপর জাদুমিশ্রিত অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে সিকন্দর গাজির সৈন্যরা পরাস্ত হয়। এরপর ঘটনাক্রমে শাহজালালের (র.) সাথে দেখা হয় সিকন্দর গাজির। তখন তাঁদের সৈন্য সংখ্যা তিন শত ষাট-এ গিয়ে দাঁড়াল।
সিকন্দর গাজি তার সকল কথা শাহজালালকে (র.) সবিস্তারে জানালেন। তিনি তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘আমিও এসেছি সকল অপশক্তি ধ্বংস করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে, তাই তুমি যদি সিলেট-বিজয় করতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে আসতে পার।’ হযরত শাহজালাল (র.) যোদ্ধাগণকে সঙ্গে নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। ব্রহ্মপুত্রের তীরে পৌঁছে দেখলেন এখানে কোনো নৌকা নেই। তিনি তার জায়নামাজ বিছিয়ে দিয়ে সকলকে নিয়ে নদী পার হন বলে লোকশ্রম্নতি রয়েছে। তাঁরা যখন সিলেটের চৌকি পরগনায় পৌঁছলেন, তখন গৌড়গোবিন্দের সৈন্যরা তাঁর প্রতি অগ্নিবাণ ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু হযরত শাহজালাল (র.) তাঁর অলৌকিক ক্ষমতায় তা প্রতিহত করলেন, যা ফিরে গিয়ে গৌড়গোবিন্দের আস্তানায় অন্ধকার জালের সৃষ্টি করল। এ দৃশ্য দেখে সৈন্যরা ঘাবড়ে গেল।
এ খবর শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন গৌড়গোবিন্দ নিজেও। এ অবস্থায় হযরত শাহজালাল (র.) বরাক নদীর তীরে এসে পৌঁছলেন। কিন্তু এখানেও পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই। আবারও তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে নদী পার হন বলে লোকশ্রুতি আছে। তারপর সিলেট শহরের দক্ষিণ দিকে জালালপুর পরগণায় এসে পৌঁছেন। এসময় গৌড়গোবিন্দ একটি বিশাল লোহার কামান হাতির ওপর সওয়ার করে শাহজালালের কাছে পাঠালেন। রাজার দূতরা জানাল, তিনি যদি ধনুতে শরযোজনা করতে পারেন, তাহলে তিনি তার জাদুটোনা থেকে বিরত থাকবেন এবং বিনাযুদ্ধে রাজ্যভার ছেড়ে দেবেন।
শাহজালাল (র.) তার শর্ত মেনে নেন। এরপর হযরত শাহজালাল (র.) তাঁর সফরসঙ্গী নাসিরউদ্দিনকে ধনুতে শরযোজনা করতে বললেন। কিন্তু তা খুবই কষ্টকর ছিল। নাসিরউদ্দিনের এ অবস্থা দেখে হযরত শাহজালাল (র.) তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা তাঁকে সহযোগিতা করেন। সঙ্গে সঙ্গে নাসিরউদ্দিন সফল হন। এই অসাধ্য সাধন দেখে চারদিক থেকে হর্ষধ্বনি ওঠে এবং আকাশবাতাস প্রকম্পিত হয়। এরপর কামানটি গৌড়গোবিন্দের দিকে এগিয়ে আসে। কোনোক্রমে রাজা পলায়নের উদ্দেশ্যে কাছাড়ের পথ ধরলেন। এরপর থেকে তার আর কোনো হদিস মেলেনি।
হযরত শাহজালাল (র.) এখানে রাজ্য জয় করে দেখেন তাঁর পীর সৈয়দ আহমদ কবিরের দেওয়া এক মুঠো মাটির সাথে এখানকার মাটির অদ্ভূত মিল রয়েছে। তিনি সিলেট শহরের দরগা মহলস্নায় একটি ছোট্ট টিলায় তাঁর আস্তানা গাড়লেন। এখানে বসেই এবাদত-বন্দেগি করতে থাকেন। তিনি তাঁর সঙ্গীদেরকে শহরের বিভিন্ন স্থানে, পরগণায় ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠিয়ে দেন। শুধু ইয়েমেনের রাজপুত্র, হাজি ইউসুফ ও হাজী খলিলসহ আরো কয়েকজন খাদেমকে তাঁর কাছাকাছি রাখেন বলে জানা যায়। এখান থেকে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন এবং নিজের আস্তানাকে ধ্যান ও সাধনার এক অনুপম লীলাক্ষেত্রে পরিণত করেন। হযরত শাহজালাল (র.) ছিলেন কিংবদমিত্মতুল্য। জাতিধম,র্ বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের আধ্যাত্নিক শক্তি যোগাচ্ছেন এই সাধক পুরুষ।
বাংলা ভাষায় লেখা সিলেট অঞ্চলের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ ‘শ্রীহট্ট দর্পণ’-এ বলা হয়েছে-হযরত শাহজালাল (র.) যে ছোট্ট টিলায় বাস করতেন, মৃত্যুর পর সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। দাফনের পর তাঁর কবরের চারপাশে ছোট্ট দেওয়াল তোলা হয়। পাশেই বানানো হয় একটি মসজিদ। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্নিক পুরম্নষ হযরত শাহজালাল (র.) ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেটে আগমন করেন। তিনি ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ৬৯ বছর বয়সে ইমেত্মকাল করেন। তিনি ছিলেন চিরকুমার। এজন্যই হযরত শাহজালালকে (র.) বলা হতো মজররদ।
মহাপ্রভূ শ্রী চৈতন্যদেবের বাড়ী:
বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষের বাড়ী তাঁরই নামে খ্যাত মন্দির। তেরো ধাপ সিড়ি ভেঙে উপরে উঠলে মন্দিরপ্রাঙ্গণ। প্রথমেই সিংহদ্বার। বামদিকে পাশাপাশি পাঁচটি ছোট মন্দির। এগুলোর নাম হল- নাট মন্দির, দোল মন্দির, রাম মন্দির, শ্রীমন্দির আর ভোগ মন্দির। এখানে দোল মন্দিরই মূল মন্দির। পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্য ছিলেন বাংলার একজন সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক। তিনি ২৫ বছর বয়সকালে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন। জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেন। শ্রীকৃষ্ণের মানবিগ্রহ হিসেবে লাখ লাখ লোকের দ্বারা তিনি পূজিত হন। বাংলার ঘরে ঘরে তাঁর নাম প্রচার হয়। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণির লোককে তিনি ভাইয়ের মতো আলিঙ্গন করে গেছেন। তাঁর কিছু কিছু শেস্নাক মন্দিরের গায়ে লেখা হয়েছে। এমন একটি হল: ‘মানুষ মানুষের ভাই’। ৮৯১ বঙ্গাব্দের ২৩ ফাগুন পূর্ণিমা তিথিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে নাম রাখা হলো বিশ্বম্ভর। ওর মা ডাকতেন ‘নিমাই’ বলে। একসময়ে গৃহত্যাগ করে তিনি সন্ন্যাসী হন।
সিলেটী নাগরী লিপি
সিলেটের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উজ্জ্বলতম দলিল নাগরী লিপি। এই রীতিতেই রচিত তৎকালীন উন্নত সাহিত্য। সিলেটের আঞ্চলিক বা কথ্য ভাষার রয়েছে বিজ্ঞান সম্মত লিপি মালা। গবেষক ও ভাষা বিজ্ঞানীদের কাছে এটি রীতিমতো বিস্ময়কর। নাগরীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-এটি সিলেট অঞ্চলের মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব সম্পদ।
নাগরীর অক্ষর মাত্র ৩২টি। যুক্ত বর্ণ সাধারণত ব্যবহৃত হয় না। মাত্র আড়াই দিনে শেখা যায়। তাই মহিলাদের মধ্যে নাগরীর প্রচার ও প্রসার ছিল বেশী। এখনো অনেক মহিলা নাগরী জানেন।
নাগরীতে রচিত পুঁথি পুস্তকের বিষয়বস্তু প্রধানত নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ইসলামী ইতিহাস, ঐতিহ্য, কাহিনী এবং রাগ, বাউল ও মরমী সঙ্গীত। এ পর্যন্ত ৮৮টি মুদ্রিত গ্রন্থসহ (নাগরী হরফে) ১৪০টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘সিলেটী নাগরী লিপি ভাষা ও সাহিত্য’ সম্পর্কে গবেষণা করে জনাব গোলাম কাদির ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। নাগরী সাহিত্যে ছাদেক আলী সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি। তিনি ১৭৯৮ সালে কুলাউড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগে তার নাম ছিল গৌর কিশোর সেন। ১৮২৩ সালে তিনি মৌলভীবাজারের মুনসেফ ছিলেন।
নাগরী পুঁথি রচয়িতাদের মধ্যে এ পর্যন্ত মুন্সী ইরপান আলী,দৈখুরা মুন্সী, আব্দুল ওহাব চৌধুরী, আমান উল্যা, ওয়াজি উল্যা, শাহ হরমুজ আলী, হাজী ইয়াছিনসহ ৫৬ জনের পরিচিতি পাওয়া গেছে। গোলাম হুসনের লিখিত ‘তালিব হুসন’কে প্রথম গ্রন্থ রুপে ধরে নেওয়া হয়। ড: সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীকে নাগরী লিপির প্রচলন কাল বলে মত প্রকাশ করেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে মোঘলদের দ্বারা তাড়িত হয়ে সিলেটে আগত আফগান পাঠানরা এর সৃষ্টি করেন। এ ব্যাপারে আরেকটি মত চালু রয়েছে। সেটি হল- ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সৃষ্ট সংস্কৃত বহুল বাংলার বিকল্প রুপে সিলেটীরা এই লিপি ও সাহিত্যের জন্ম দেন।
নাগরী লিপিতে সাহিত্য সৃষ্টির অনেক পর এর মুদ্রণ শুরু হয়। টাইপ ও ছাপা খানার অভাবে হাতে লিখেই নাগরীর প্রসার ঘটে। এ সময় সিলেট শহরের হাওয়াপাড়া নিবাসী মৌলভী আব্দুল করিম ইউরোপ সফর শেষে দেশে ফেরেন। নাগরী লিপির টাইপ তৈরি করে চালু করেন ছাপা খানা। বন্দর বাজারে স্থাপিত ঐ প্রেসের নাম ছিল ইসলামিয়া প্রেস। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রেসটি বোমায় পুড়ে যায়। সিলেট শহরের নাইওরপুলে ছিল সারদা প্রিন্টিং পাবলিশিং। ১৯৪৭ পূর্ববর্তীকালে কলকাতা ও শিয়ালদহেও নাগরী লিপির প্রেস ছিল। বৃহত্তর সিলেট, কাছাড়, করিমগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় নাগরী লিপি ও সাহিত্যের প্রচার ও সমাদর ছিল। বর্তমানে নাগরীর চর্চা কম হলেও তা একেবারে হারিয়ে যায়নি।
সিলেট জেলার ভৌগোলিক অবস্থান
২৪০৩৬˝- ২৫০১১˝ উত্তর অক্ষাংশ হতে ৯১০৩৮˝- ৯২০৩০˝পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। আয়তন ৩,৪৫২.০৭ বর্গ কি.মি বা ১৩৩২.০০ বর্গমাইল । সিলেটের উত্তরে ভারতের খাসিয়া, জৈন্তিয়া পাহাড় (ভারতের মেঘালয় রাজ্য), দক্ষিণে মৌলভীবাজার জেলা, পূর্বে ভারতের কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলা (ভারতের আসাম রাজ্য) ও পশ্চিমে সুনামগঞ্জ এবং হবিগঞ্জ জেলা
সিলেট জেলার উপজেলা
১৩টি উপজেলা গুলো হল:
• বালাগঞ্জ উপজেলা
• বিয়ানীবাজার উপজেলা
• বিশ্বনাথ উপজেলা
• কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা
• ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা
• গোলাপগঞ্জ উপজেলা
• গোয়াইনঘাট উপজেলা
• জৈন্তাপুর উপজেলা
• কানাইঘাট উপজেলা
• সিলেট সদর উপজেলা
• জকিগঞ্জ উপজেলা
• দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ও
• ওসমানী নগর উপজেলা
সিলেট জেলার নদ-নদীঃ
বৃহত্তর সিলেট জেলার ৩৬টি নদী
সুরমা, পিয়াইন, গাঙ্গ, সারি, গোয়াইন, বাগরা গাং, নওয়া গাং, শেওলা, ধামালিয়া, মনাই, বড়দাল, জুরি, মনু, ধলাই, লংলা (কারাঙ্গি), খোয়াই, সুতাং, কুশিয়ারা, মাধবপুর, মহাসিং
খাজাঞ্জি, ভট্টখা্ কালনি, জামালপুর, বরাবা, নদী লভা, হরি, বোগাপানি, ধরিয়ানা, ধোয়াই, যাদুকাটা, ধলা-ধলাই গাং, গোপলা-লঙ্গল, মোগাই-চলতি, রক্তিপৈন্দা, ভেরা, মোহনা, ধনু, বৌলাই।
সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
• জাফলং
• ভোলাগঞ্জ
• লালাখাল
• তামাবিল
• হাকালুকি হাওর
• ক্বীন ব্রীজ
• হযরত শাহজালাল ও হযরত শাহ পরাণ এর মাজার শরীফ
• মহাপ্রভু শ্রী চৈত্যনো দেবের বাড়ী
• হাছন রাজার মিউজিয়াম
• মালনি ছড়া চা বাগান
• ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর
• পর্যটন মোটেল
• জাকারিয়া সিটি
• ড্রিমল্যান্ড পার্ক
• কৈলাশটিলা
• হাকালুকি হাওর
• লালাখাল
• পাংতুমাই
• আলী আমজদের ঘড়ি
• জিতু মিয়ার বাড়ী
• মনিপুরী রাজবাড়ি।
• মনিপুরী মিউজিয়াম
• শাহী ঈদগাহ
• ওসমানী শিশু পার্ক
• মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত
• সিলেটি নাগরী লিপি
• পাংতুমাই
• রাতারগুল
• টাংগুয়ার হাওর
• লোভাছড়া
• হাম হাম জলপ্রপাত
• কৈলাশটিলা
• পরিকুণ্ড জলপ্রপাত
• সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান
• হারং হুরং
• বরাক নদীর তিন মোহনা
সিলেট জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব
• জেনারেল এম,এ,জি ওসমানী
• আগা মোহাম্মদ বেগ সিলেটে ব্রিটিশ বিরুধী আন্দলোনের সংগঠক ও নেতৃত্বদাতা।
• সাইফুর রহমান সাবেক অর্থমন্ত্রী
• আবুল মাল আব্দুল মুহিত
• নুরুল ইসলাম নাহিদ
• বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী
• হেমাঙ্গ বিশ্বাস
• গোবিন্দ চন্দ্র দেব (১৯০৭-১৯৭১)
• সুহাসিনী দাস
• খান বাহাদুর এহিয়া চৌধুরী (১৮৫১-১৯২৫)
• হেনা দাস
• শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৫-১৫৩৩)
• শিতালং শাহ (১৮০৬-১৮৯৯)
• রাজা গিরিশচন্দ্র রায় (১৮৪৫-১৯০৮)
• মরহুম আল্লামা শেখ আব্দুল্লাহ হরিপুরী
• শরচ্চন্দ্র চৌধুরী (১৮৫১-১৯২৭)
• বাধানাথ চৌধুরী (১৮৫৬-১৯৯২)
• সুন্দরীমোহন দাস (১৮৫৭-১৯৫০)
• মৌলভী আবদুল করিম (১৮৬৩-১৯৪৩)
• অচ্যুতচরণ চৌধুরী (১৮৬৫-১৯৫৩)
• শিতালং শাহ (গিতিকার)
• গজনফর আলী খান (১৮৭২-১৯৫৯)
• আরকুম শাহ (১৮৭৭-১৯৪১)
• গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৯৪১)
• পূর্ণেন্দুকিশোর সেনগুপ্ত (১৮৯৫-১৯৭৮)
• যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য (১৯০৫-১৯৯০)
• আবদুল গফ্ফার চৌধুরী (১৯১২-১৯৬৬)
• আলী আমজাদ খা (১৮৬৯-১৯৫০)
• রাধা রমন দত্ত-(১৮৩৬-১৯১১)
• শাহ আবদুল করিম (১৯১৬- ২০০৯)
• দুরবিন শাহ
• সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতি
• সালমান শাহ
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া , তথ্যবাতায়ন
আরও পড়তে পারেনঃ বরিশাল জেলার পরিচিতি ও ইতিহাস