গল্প

ফার্স্ট ক্লাস এর যাত্রী

ফার্স্ট ক্লাস এর যাত্রীফার্স্ট ক্লাস এর যাত্রী

ফার্স্ট ক্লাস এর যাত্রী

একে দৈব ছাড়া আর কী বলবেন? ভাবা যায় আমাদের পাড়া গাঁর নদীতে চলছে লঞ্চ! গ্রামে খুশির একটা বড় সড় বন্যা বয়ে গেল বলা যায়। গাঁয়ের রাস্তায় শীত কালেও হাঁটু পর্যন্ত কাঁদা, নদী ছাড়া এ গণ্ডগ্রামের মানুষদের দূরে যাতায়াতের কোন ভাল উপায় নেই অথচ যানবাহন বলতে একমাত্র নৌকা। এই নৌকার ধীর গতি আর এতে চড়ে যাত্রীর ঘুমিয়ে যাওয়া, তুফানে উলটে পড়া, ইত্যাদি নিয়ে এতদিন কত গল্প যে লোক মুখে প্রচলিত ছিল তার লেখাজোখা নেই। এত্তসব গল্পের এত সহজে সমাপ্তি ঘটাতে লঞ্চ এসে হাজির হবে, তা যে আমাদের স্বপ্নাতীত! এ দৈব ছাড়া আর কী!

হালবিহীন পালবিহীন এ আশ্চর্য দেবযানের যাত্রীবহন শুরু হলো। আমরা ছেলের দল সার বেধে দাঁড়িয়ে থাকতাম রাস্তায় — কখন লঞ্চ আসে! বাড়ির বৌরা ঘোমটা টেনে এক পলক দেখতে আসতো এই অদৃষ্টপূর্ব যন্ত্রযান। এক একদিন লঞ্চ নিয়ে এক একটা নতুন ঘটনা শুনতাম আর আমদের বিস্ময়ের সীমা থাকতো না। মোদ্দা কথা ঐ কিশোর বয়সে গাঁয়ের সব ছেলেদের কৌতুহলের জগতে এই নতুন জলদেবতাটি সর্বাধিক আগ্রহের বস্তুতে পরিণত হয়েছিল।

উত্তর পাড়ার অবনীশ বাবু একদিন জামাই বাড়ি থেকে ফেরার সময় লঞ্চে করে ফিরলেন। লঞ্চঘাট ছিল গ্রামের দক্ষিণে তাই কুল ঘেঁষে লঞ্চ যখন যাচ্ছিল তখন অবনীশ বাবু হাত নেড়ে গাঁয়ের উতসুক জনতাকে নিজের অপূর্ব কীর্তির স্বাক্ষর স্বরূপ হাত নেড়ে অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। তাঁর এ অভিজাত রুচির পরিচয় পেয়ে আমরা তো হতবাক। হেঁটে হেঁটে তিনি যখন গাঁয়ে ফিরছিলেন আমরা দল বেধে যেয়ে তাকে নতুন কেনা ষাঁড়ের মত ফুলের মালা পরিয়ে বাড়ি পর্যন্ত প্রায় মিছিল দিতে দিতে নিয়ে এলাম। বিজ্ঞেরা বলতে লাগলেন অবনীশ বাবু এ টুকু সম্মান দাবী করতেই পারেন এই অপার সৌভাগ্যের প্রশংসা-স্বরূপ।

গ্রামের এই লঞ্চপ্রীতি কিন্তু সুধাংশু বাবুকে মহাবিরক্ত করে তুললো। আজকাল মানুষের এই হুজুগে মেতে ওঠা স্বভাব তার মোটেও পছন্দ নয়। প্রকৃতপক্ষে এ সকল যানবাহনের নানা রকম যান্ত্রিক জটিলতা তাঁর কাছে কিছুটা ভয়েরও বটে। ছেলে ছোকড়াদের মত এ সব বুজরুকি ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ কম কিন্তু অবনীশ বাবুকে ফুলের মালা পরানো ব্যাপারটা তাকেও ভিতরে ভিতরে কেমন যেন লঞ্চ সম্পর্কে উৎসাহী করে তুললো। গাঁ ভরা লোকের সামনে এত সম্মান আগে কে পেয়েছে কোনকালে? এই সম্মানের লোভে হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক লঞ্চ নিয়ে তার মহা কৌতুহল না থাকলেও তাতে চড়ার আগ্রহ তাকে পেয়ে বসলো। প্রায় হঠাৎ করেই তিনি এক কাণ্ড করে বসলেন। তাঁর মেজ মেয়ের শাশুড়ির শ্রাদ্ধে যাবার আগে খুব গোপনে সুধীরকে ডেকে বললেন, বাবা সুধীর তুই একটা ব্যবস্থা করে দে না!

সুধীর হাঁ করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাতে সুধাংশু বাবু বুঝিয়ে বললেন যে, তিনি চালনা যাবেন তাই লঞ্চে যেন যেতে পারেন তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সুধীর আরও কিছুক্ষণ হাঁ করে থাকলেও বেশি প্রতিক্রিয়া দেখালো না, বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সে অত্যন্ত চটপটে কায়দায় বললো, ও তুমি কিচ্ছুটি ভেব না, জলদি করে দশটা টাকা ছাড়ো, আমি কাল টিকিট করে এনে দিচ্ছি। যাবে কবে, পরশু?
সুধাংশু বাবু সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন। সুধীর তাঁর কাছ থেকে দশটা টাকা নিয়ে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেল।

বেলা গড়াতে না গড়াতে সুধাংশু বাবুর এই লঞ্চে চড়ার কথা গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে গেল। যারা আগে কখনও লঞ্চে চড়েনি তারাও বহুদর্শী বিজ্ঞের মত লঞ্চ সম্পর্কে দুকথা বলতে যেচে আসতে লাগলো সুধাংশু বাবুর বাড়ি। বিশু এসে বললো, ‘জ্যেঠা ,আগেভাগে টিকেট করে না রাখলে কিন্তু তুমি বসার জায়গা পাবে না’। কেউ বললো, ‘জ্যেঠা, পা ঝুলিয়ে কিন্তু বসবে না, বিপিন চৌকিদারের পায়ের গোড়ালির কি হাল হয়েছিল তা ত জানো!’ সুধাংশু বাবু এসব কথায় ক্রমাগত উৎসাহ থেকে ভয় পেতে শুরু করলেন।

যাইহোক নির্ধারিত দিনে সুধাংশু বাবু দুরু দুরু বুকে বাড়ি থেকে রওনা হলেন সেই মহা আশ্চর্য জলযানে চড়ার অভিলাশে। আহা, ভাবতেও ভাল লাগে যে এমন একটা মহৎ ব্যাপারে সামিল হতে যাচ্ছেন তিনি। সুধীর এসে সঙ্গ নিল। লঞ্চ ঘাট পর্যন্ত ত্রিশ মিনিটের রাস্তা যেতে যেতে তিনি সুধীরের কাছ থেকে টিকিট বুঝে নিলেন। সুধীর অত্যন্ত করিতকর্মা লোক, সুধাংশু বাবু তার কাজের তৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন।

ছেলেটাকে কাণ্ডজ্ঞানহীন অপবাদ দিয়ে আগে কতই না গালিগালাজ করেছেন, আজ সেই সব পূর্বকৃত অপরাধের জন্য তার মনে বেশ অস্বস্তি হতে লাগলো! সুধীর আগেই তাকে জানিয়েছিল ফার্স্ট ক্লাস এর টিকিট করেছে, এখন সাথে করে একটা মাদুর নিয়ে এলে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাতে ঘুমাতে তিনি আভিজাত্যের সাথে যেতে পারবেন – সুধীরের কথা তিনি পালন করেছেন। বগলদাবা করে সখের ছাতাটি নিয়ে গর্বিত পদসঞ্চালণে চলেছেন সুধাংশু বাবু, সুধীর অবশ্য বিনয় করে সুধাংশু বাবুর মাদুরটা বয়ে নিয়ে নিজেকে ভাগ্যবান বলে গর্ববোধ করছে। সুধীর বললো, ‘তুমি কোন দুশ্চিন্তা করো না জ্যেঠা, ব্যবস্থা একেবারে পাক্কা। তুমি আরামেই যাবে, নিজস্ব কামরা পাবে, প্রস্বাব পায়খানার জন্য বাইরেও বের হওয়ার দরকার পড়বে না’।

অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে লঞ্চ এসে ঘাটে থামলো। ভীড় ঠেলে জ্যেঠাকে লঞ্চে উঠিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে এলো সুধীর। সুধাংশু বাবু লঞ্চে উঠে অবাক বনে গেলেন। বাপরে, মানুষের এত বড় ক্ষমতা! মনে হলো দুনিয়ার সব জিনিস আর সুখভোগের ব্যবস্থা এই লঞ্চে আছে। সুধীরের বিবরণ অনুযায়ী লঞ্চের পিছন দিকে পৌঁছাতে বেশি বেগ পেতে হল না, কারণ যাত্রী সংখ্যা বিশু যেমন বলেছিল তেমন বিপুল নয়। সত্যি, গ্রামের লোকেরা কতই না বাড়িয়ে কথা বলে, ঘরের বার না হলে তিনি তা বুঝতেই পারতেন না।

সুধীরের বিবরণ অনুযায়ী লঞ্চের পেছনে যেয়ে তিনি কেবিন দেখতে পেলেন। খোশ মেজাজে দরজা খুলতেই কি সব রান্নার হাড়ি পাতিল দেখে তিনি বেশ হতাশ হলেন। দরজাটা বন্ধ করে তিনি পাশের অন্য একটি দরজা দেখে সেটি খুলনেন, বাহ এইতো, ছোটখাটো একটা কক্ষ! একটা বদনাও রাখা আছে, বেশ খানিকটা জায়গাও আছে মাদুর ফেলার। কিন্তু আগে যে ভদ্রলোক এ কামরায় চড়েছিলেন তিনি বেশ অসভ্য, জায়গাটিকে কেমন যেন নোংরা করে রেখে গেছেন। তার প্রস্বাবের দুর্গন্ধ এখনও থেকে গেছে। সবার কি আর কাণ্ডজ্ঞান সমান! আক্ষেপ করতে করতে সুধাংশু বাবু বাইরে থেকে জল এনে পরিস্কার করে বেশ পরিপাটি হয়েই ফার্স্ট ক্লাস এ জাঁকিয়ে বসলেন। জায়গাটি একজনের শোয়া বসার জন্য খাসা । সুধীরের ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে মনে মনে আবারও ধন্যবাদ দিতে লাগলেন।

শীতের দিন, এ ফার্স্টক্লাস কক্ষের উষ্ণতায় আরামে সুধাংশু বাবুর চোখ বুজে এলো। কিন্তু কি উটকো ঝামেলা শুরু হলো এ? থেকে থেকে কে যেন এসে তার দরজায় টোকা মেরে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর।
যা করে করুজ্ঞে বাপু, এমন ফার্স্ট ক্লাস কক্ষে আরামে থাকলে অন্যের তো ঈর্শা জাগবেই। বলিহারি মানুষের ঈর্শা, ওরে আমার টাকা আছে আমি চড়েছি ফার্স্ট ক্লাস এ। অত সখ থকলে তোমরাও যাওনা বাপু এমন একটা কেবিন রুমে, কে মানা করেছে? ভাবছেন সুধাংশু বাবু।

অনেক টোকাটুকির পর এবার বাইরে থেকে একটা গলা শোনা গেল, ‘আরে ভেতরে কে আছেন? বের হন আমরাদেরও সুযোগ দিন।

সুধাংশু বাবু চুপ করে রইলেন। না, কিছুতেই দরজা খুলবেন না তিনি। তাঁর অমন সাধের ফার্স্ট ক্লাস এ আর কাউকে ঢুকাতে চান না তিনি।

তাঁর চুপ করে থাকায় বাইরের যাত্রীটি বোধ হয় ক্ষ্যেপে গেল, কড়া স্বরে চিৎকার করে দরজা খুলতে বললেন। সুধাংশু বাবুও নাছোড়বান্দা। ফার্স্ট ক্লাস এর টিকেট করা তাঁর, দরজা খুলে অন্য লোক ঢুকিয়ে গাদাগাদি করার মত উদারতায় তিনি মোটেও উৎসাহী নন। তিনি বেশ উচ্চস্বরেই জানিয়ে দিলেন যে, লঞ্চে যতই স্থানাভাব হোক না কেন, তার ফার্স্টক্লাস কেবিনে অন্য লোক ঢুকিয়ে তিনি নিজের শান্তি ভঙ্গ করতে চান না। লোকগুলো দারুণ নাছোড়বান্দা — সুধাংশু বাবুরও জেদ কম নয়। তিনি তাদের কথা উপেক্ষা করে কানে তুলো দিয়ে পড়ে রইলেন। ফার্স্ট ক্লাস এর যাত্রী তিনি, অন্যদের তো হিংসা হবেই, লঞ্চে যেন জায়গার আকাল হয়েছে! পৃথিবীও যে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে তা যেন তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছেন।

কিছুক্ষণ পর কোন এক উত্তেজিত বুনো যাত্রীর প্রবল পদাঘাতে দরজার পাল্লার কব্জা গেল ছুটে। হতবাক যাত্রীরা বিরক্তি, রাগ আর কৌতুহলে তাকিয়ে দেখল টয়লেটের ভেতরে একটা লোক মাদুর বিছিয়ে পিঠে ঠেস দিয়ে আরামে বসে আছে! লোকটাকে পাগল বলে মেনে নিতে যতটুকু সময় লাগে তার আগেই সুধাংশু বাবুর জামা ছিড়ে গেল, তার সাধের ছাতাটি তারই কাঁধে বেশ জোরে আছড়ে পড়ে ভেঙে গেল। বিস্মিত সুধাংশু বাবু ফার্স্ট ক্লাস এর উল্লেখ করতেই কে একজন ক্রোধে তার চোয়ালে এমন বজ্র মুষ্ঠি ঝাড়লো যে সাথে সাথেই তার আবাল্য পরিচিত চেহারাটা নিমেশেই অন্য কোন বিকৃত প্রাণীর মুখের আকার ধারণ করলো। বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা তাকে তার মাদুর আর ভাঙা ছাতা সমেত চ্যাংদোলা করে জলে নিক্ষেপ করে টয়লেট উদ্ধার পর্বের সমাপ্তি টানলো।

নিতান্ত অপটু কুকুর ছানার মত প্রাণপণে সাঁতরিয়ে ডাঙায় উঠলেন সুধাংশু বাবু। আর মেয়ের শাশুড়ির শ্রাদ্ধে যাওয়া হল না তাঁর। রাগে, অপমানে ফুলতে ফুলতে তিনি তীরে দাঁড়িয়ে মরিয়া হয়ে ফেরার উপায় খুঁজতে লাগলেন কিন্তু ভেজা আর কর্দমাক্ত শরীরে তাকে দেখে পাগল ভেবে কেউই নৌকায় তুলতে সম্মতি জানালো না। অবশেষে বেশি বখশিসের লোভ দেখিয়ে একটা মাছ ধরা নৌকায় করে তিনি বাড়ির পথ ধরলেন।

সেদিন অনেক রাত্রে গ্রামে কিসের যেন শোরগোল পড়ে গেল। আমরা সবাই যে যার মত হারিকেন হাতে নিয়ে ত্রস্ত পায়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম — ব্যাপারখানা কি তা দেখতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম প্রাণপণে দৌড়ে পালাচ্ছে সুধীর কিন্তু তার হাসি হাসি মুখ দেখে দৌড়ের কারণ আন্দাজ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। একটু পরে দেখি সুধীরের পেছন পেছন যমদূতের ভঙ্গীতে এক হাতে হারিকেন ,অন্য হাতে বড় এক খানা দা আর মুখে অবিরাম গালি নিয়ে তেড়ে ফুড়ে আসছেন ফার্স্ট ক্লাস এর যাত্রী সুধাংশু বাবু।

সংগৃহীত ও সর্বশর্ত সংরক্ষিত বিকাশ রায়

 

আরও পড়ুন ব্যান্ডপার্টির হালিম

Leave a Reply

%d bloggers like this: