অ্যান্টিবায়োটিক (antibiotic)
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ যেটি এক প্রকার জৈব-রাসায়নিক ঔষধ যা অণুজীবদের (বিশেষ করে ব্যাক্টেরিয়া) নির্মূল করার পাশাপাশি ব্যাক্টেরিয়ার দৈহিক বৃদ্ধি এবং তার কলোনিগুলিতে বংশবিস্তার রোধ করে। এটা এমন একটা উপাদান যা ব্যাক্টেরিয়া বা ফাঙ্গাস থেকে সংগ্রহ করে অন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস কে ধ্বংস জন্য বা তার বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। সাধারাণত এক এক অ্যান্টিবায়োটিক এক এক ধরনের প্রক্রিয়ায় অণুজীবের বিরুদ্ধে কাজ করে। অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণভাবে কেবল নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার হয় এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে না।
অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের ইতিহাস
প্রাকৃতিক উপাদানের যে রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা আছে, তা অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের বহু পূর্বে মানুষের জানা ছিল। শতবর্ষ পূর্বে চীনে সয়াবিনের ছত্রাক মৌল্ড (Mould) আক্রান্ত ছানা (Mouldy Soyabean Curd) বিভিন্ন ফোঁড়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত। চীনারা পায়ের ক্ষত সারাবার জন্য ছত্রাক মৌল্ড আবৃত জুতা পড়ত। ১৮৮১ সালে ব্রিটিশ অণুজীব বিজ্ঞানী জন টিন্ডাল (John Tyndall) ছত্রাকের জীবাণু প্রতিরোধী ভূমিকা লক্ষ্য করেন।
লুই পাস্তুর এবং জোবার্ট লক্ষ্য করেন কিছু অণুজীবের উপস্থিতিতে প্রস্রাবে অ্যানথ্রাক্স ব্যাসিলি (Anthrax) জন্মাতে পারেনা। ১৯০১ সালে এমারিখ (Emmerich) এবং লও (Low) দেখেন যে অ্যানথ্রাক্স ব্যাসিলি ( Anthrax bacili) আক্রমণ থেকে খরগোশকে বাঁচানো সম্ভব যদি সিউডোমোনাস এরুজিনোসা (Pseudomonas aeruginosa) নামক ব্যাক্টেরিয়ার তরল আবাদ (Liquid culture) খরগোশের দেহে প্রবেশ (Inject) করানো যায়। তারা মনে করেন ব্যাক্টেরিয়াটি কোনো উৎসেচক (enzyme) তৈরি করেছে যা জীবাণুর আক্রমণ থেকে খরগোশকে রক্ষা করছে। তারা এই পদার্থের নাম দেন পাইওসায়ানেজ (Pyocyanase)।
১৯২০ সালে গার্থা ও দাথ কিছু গবেষণা করেন এই জাতীয় জীবাণু নাশক তৈরি করতে। তারা অ্যাকটিনোমাইসিটিস (Actinomycetes) দ্বারা প্রস্তুত একধরনের রাসায়নিক পদার্থ খুঁজে পান যার জীবাণুনাশী ক্ষমতা আছে। তারা এর নাম দেন অ্যাকটিনোমাইসিন। যদিও কোন রোগের প্রতিরোধে এই পদার্থ পরবর্তীতে ব্যবহৃত হয় নাই। পরিশেষে ১৯২৭ সালে লন্ডনের সেন্ট মেরি হাসপাতালে কর্মরত অণুজীব বিজ্ঞানী স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের (Alexander Fleming) পেনিসিলিন (Penicillin) আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বিশ্ব প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক এর স্বাক্ষী হয়।
তার অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের ঘটনাটি ছিল এরূপ:
ফ্লেমিং তার এক পরীক্ষার (Experiment) সময় লক্ষ্য করেন জমাট আবাদ মাধ্যমে (Solid culture medium) ছত্রাকের উপস্থিতিতে স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস (Staphylococcus aureus) নামক ব্যাক্টেরিয়া জন্মাতে পারেনা (যদিও আবাদ মাধ্যমে তখন ছত্রাকের উপস্থিতি কাম্য ছিল না তার, কিন্তু পরীক্ষাকালীন কোন এক অজানা ত্রুটির কারণে সেসময় ছত্রাক আবাদ মাধ্যমে চলে এসেছিল, আর সেই ভুল থেকেই আবিষ্কারের সূত্রপাত!)। ফ্লেমিং তখন ঐ ছত্রাকের প্রজাতি চিহ্নিত করতে ও তার জীবাণু নাশক বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করতের আগ্রহী হন। ছত্রাকটি ছিল পেনিসিলিয়াম ক্রাইসোজেনাম (Penicillium chrysogenum) প্রজাতির। ফ্লেমিং পেনিসিলিয়াম দ্বারা নিসৃত ঐ পদার্থের নাম দেন পেনিসিলিন (Penicillin) ।
অ্যান্টিবায়োটিকের প্রথম ব্যবহারিক প্রয়োগ
১৯৪১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম পেনিসিলিন মানুষের দেহে প্রয়োগ হয়। অক্সফোর্ডের একজন পুলিশ কর্মকর্তা স্ট্যাফাইলোকক্কাস দ্বারা আক্রান্ত হলে পেনিসিলিন প্রয়োগে তার অবস্থার নাটকীয় উন্নতি ঘটে। কিন্তু পাঁচ দিন পর পেনিসিলিয়ামের সরবরাহ শেষ হয়ে গেলে তিনি আবার আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং মারা যান। ১৯৪০-৪১ সালের দিকে ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে পেনিসিলিনের গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ কমে যায়। কিন্তু ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার আমেরিকান বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলশ্রুতিতে, রকফেলার ফাউন্ডেশন (Rockefeller Foundation) ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ডাব্লিউ ফ্লোরে (Harold W. Florey) ও এন.জি. হিটলিকে (N. G. Heatly) আমেরিকায় আমন্ত্রণ জানান।
২ জুলাই ১৯৪১ সালে তারা আমেরিকায় পৌঁছেন এবং বিশ্ববিখ্যাত ছত্রাকবিদ চার্লস থম (Charles Thom) ও আমেরিকার কৃষি বিভাগের (U.S. Department of Agriculture) সাথে আলোচনা করেন। খুব দ্রুতই আমেরিকার ইলিনয়ের (Illiniois) পিওরিয়া (Peoria) গবেষণাগারে তাদের কাজ শুরু হয়। ফ্লেমিং যে ছত্রাক পেয়েছিলেন তা ২ একক/মিলিলিটার (unit/mililiter) পেনিসিলিন তৈরি করত, কিন্তু কয়েকমাসে আমেরিকাতে বিজ্ঞানীরা প্রায় ৯০০ একক/মিলিলিটার পেনিসিলিন প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। ব্রিটেন, আমেরিকার বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, ফ্লেমিং এর সেই ভুলের কারণে পাওয়া ছত্রাক (পেনিসিলিন) এক “যাদুর ঔষধ” তৈরি করতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের ক্ষত সারাতে প্রথম পেনিসিলিনের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে অসংখ্য জীবন বাঁচায়। ১৯৪৫ সালে ফ্লেমিং, আর্নেস্ট চেইন, ও ফ্লোরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাদের অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার (Nobel Prize) লাভ করেন। বর্তমানে প্রায় ৫০,০০০ একক/মিলিলিটার পেনিসিলিন প্রস্তুত করা সম্ভব হয়েছে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে অন্যান্য অনেক জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হয়।
অণুজীবের অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির কারণ
সাধারণত অণুজীবরা অন্য অণুজীবদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জয়লাভের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করে থাকে। ব্যাকটেরিয়া নিজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারেনা বিধায় নিজেদের অঞ্চল থেকেই তাদের খাদ্য সংগ্রহ করার কারণে তারা একই অঞ্চলে থাকা অন্য ব্যাকটেরিয়া গুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে। এক ব্যাকটেরিয়া আরেক ব্যাকটেরিয়া কে মারার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক তৈরী করে। যা আমরা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করি।
বহুল প্রচলিত কিছু অ্যান্টিবায়োটিক এর ব্যবহার:
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কী?
অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স অর্থ্যাৎ জীবাণু এর বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। এই ক্ষেত্রে ঔষধ খেয়েও ভালো ফল পাওয়া যায় না, কারণ জীবাণুর বিপক্ষে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করতে পারেনা।
ব্যাক্টেরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে ওঠা ও বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা
মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণে প্রতি বছর ক্যান্সারের চেয়ে-ও বেশি লোক মারা যায়, সারা পৃথিবী জুড়ে বছরে প্রায় ৭ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন, এবং ধারণা করা হচ্ছে যে ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ১০ মিলিয়নে।
অনেক রোগ, যেগুলোর আগে চিকিৎসা করা যেতো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের মাধ্যমে সেইসব রোগের ক্ষেত্রে-ও এই প্রতিরোধ গড়ে উঠছে, যেমন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে গনেরিয়া (এক ধরনের যৌনতা-বাহিত রোগ) রোগটি প্রায় চিকিৎসার অসাধ্য হয়ে উঠেছে পৃথিবীর অনেক জায়গায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণে।
এছাড়া ই. কোলাই (Escherihia Coli) ব্যাকটেরিয়ার একটি বংশ পাওয়া গেছে যেগুলো বিদ্যমান সব অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। মূত্রনালীর সংক্রমণ ও যৌনরোগ যেমন ক্ল্যামেডিয়া, সিফিলিস ইত্যাদি রোগ, যেগুলোকে আগে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দ্বারা নিরাময়যোগ্য ছিলো সেগুলো এখন প্রতিরোধী, ফলে প্রতিবছর এইসব রোগে মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ। অর্থাৎ, একই সাথে রোগযন্ত্রণা দীর্ঘ হচ্ছে এবং মৃত্যুর হার বাড়ছে।
বিশ্বের অণুন্নত অঞ্চলে অ্যান্টিবায়োটিকের সবচেয়ে অপব্যবহার ঘটে। এই সব দেশে বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলে দক্ষ লোকের অভাবে অ্যান্টিবায়োটিক প্রায় সর্বত্রই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করা হয়। এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মাত্র ৮% অ্যান্টিবায়োটিক ডাক্তারের উপদেশে বিক্রি করা হয়।
পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই সাধারণ মাথা ব্যাথা, পেটের ব্যাথা, জ্বর ইত্যাদির জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তাররা অ্যান্টিবায়োটিক খেতে বলার সময়, ঐ অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রোগির শরীরের ব্যাক্টেরিয়া আগেই প্রতিরোধী হয়ে গেছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয় না।
আবার অনেক সময় রোগের শুরুতেই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের উপদেশ দেওয়া হয়, কিন্তু হয়ত অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া রোগ নিরাময় সম্ভব ছিল। এসব কারণই অ্যান্টিবায়োটিক-রোধী ব্যাক্টেরিয়ার টিকে থাকার সম্ভবনা বাড়িয়ে দেয়।
উন্নত বিশ্বেও এই সমস্যা বিদ্যমান। আমেরিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (Center For Diseases Control) সি.ডি.সির এক জরিপে দেখা গেছে, সেখানে ডাক্তারদের অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপসনের কানের সংক্রমনের জন্য ৩০%, সাধারাণ ঠাণ্ডার জন্য ১০০%, গলা ব্যথার জন্য ৫০% প্রেসক্রিপসন অপ্রয়োজনীয়। তাছাড়া যারা হাসপাতালে কাজ করে তাদের মধ্যে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক-রোধী ব্যাক্টেরিয়া উপস্থিতি থাকে বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে যে পেট ও শরীরের ভেতরের ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণুর ভারসাম্য নষ্ট হলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, বিষণ্ণতা এবং অন্যান্য অনেক শারীরিক ও মানসিক রোগ সৃষ্টি হতে পারে। শুধু তাই নয়, পরিবেশের যাবতীয় সব চক্রে (যেমন, পানি চক্র, অক্সিজেন চক্র, কার্বন ও নাইট্রোজেন চক্র ইত্যাদি) জীবাণুদের অবদান রয়েছে, বলা হয়ে থাকে আমরা যত অক্সিজেন গ্রহণ করে তার অধিকাংশ গাছের তুলনায় জীবাণুদের (বিভিন্ন বিপাক ও জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া ও চক্রের মাধ্যমে) দ্বারা নির্গত। তাই বোঝাই যাচ্ছে আমাদের জীবন ও পরিবেশের জন্য জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়াদের গুরুত্ব কতো অপরিমেয়। তাই আমাদের টিকে থাকার জন্যই আমাদের উচিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতন হওয়া।
অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ তৈরি করা হয় সাধারণত প্রকৃতিতে সহজলভ্য বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা, অথবা অন্যান্য জীবাণুদের নির্যাস বা নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ থেকে, যেমন মাটিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া থেকে অথবা ছত্রাক থেকে বানানো পেনিসিলিন ইত্যাদি। কিন্তু এইসব সহজলভ্য প্রাকৃতিক উপাদানগুলো প্রায় “শেষ” হয়ে এসেছে, বলা হয়ে থাকে আমরা অধিকাংশ কোনো না কোনো ওষুধে ব্যবহার করে ফেলেছি। তাই বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন কৃত্রিমভাবে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ বানাতে, কিন্তু এইসব সময়সাধ্য ব্যাপার। কিন্তু নিত্য নতুন রোগ কিংবা পুরানো রোগের চিকিৎসার জন্য আমাদের নতুন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের প্রয়োজন, কারণ ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য জীবাণু দ্রুত অভিযোজিত হতে পারে। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের প্রতি প্রতিরোধ দ্রুত ঘটে।
অনেক ওষুধ কোম্পানিও ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে তাল মিলিয়ে ওষুধ তৈরি করতে পারছে না। অনেক মিলিয়ন ডলার খরচ করে একটি নতুন ওষুধ আনলেও সেটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে কয়েক বছরেই। ফলে ওষুধ কোম্পানিগুলো লোকসানের ভয়ে গবেষণায় বিনিয়োগের ব্যাপারে অনেক সতর্ক।
এছাড়া, যেসব দেশে ওষুধের দাম কীরকম হবে (বিশেষ করে মৌলিক ও জীবনরক্ষার জন্য অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের ক্ষেত্রে) সেই ব্যাপারে নির্দিষ্ট নীতিমালা বা আইন আছে, কিংবা যেসব দেশে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অধীনে অ্যান্টিবায়োটিক বিনামূল্যে (যেমন, কানাডা) বিতরণ করা হয় সেইসব দেশে প্রত্যাশিত লাভ পায় না ওষুধ কোম্পানিগুলো। তাই ওষুধ কোম্পানির প্রতি নির্ভর করে বা আশা করে থাকলে আমাদের চলবে না, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের বিপরীতে আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের আচরণ পাল্টাতে হবে।
অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সাবান, শ্যাম্পু ও প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবহার। গৃহ ও আমাদের আশপাশে সাধারণ যেসব ব্যাকটেরিয়া থাকে সেগুলোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক সাবান ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা ভালগুলোকেও মেরে ফেলি এবং খারাপগুলো আরও বেশি প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। সাধারণ সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করলেই চলে দৈনন্দিন কাজকর্মে। আমাদের এইসব আচরণ না পাল্টালে আমাদেরই বিপদ।
কৃষক শুধু মাত্র রোগ সংক্রমণ ঠেকানোর জন্যই নয়, বরং পশু মোটাতাজাকরণ ও পশুপাখির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য অনুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন। যেমন, পশুপাখি লালনপালনে ব্যবহৃত মোট এন্টিবায়োটিকের ৮০% ব্যবহৃত হয় পশুপাখিদের রোগ নিরাময়ে নয় বরং তাদের মোটাতাজাকরণে। এইসব ওষুধ কিন্তু পানি চক্রে ও আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় গিয়ে ঠেকে, ফলে এইসব সুপারবাগের বিকাশের সম্ভাবনা বা ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে চীনে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ব্যবহার এতো বেশি যে পানির ট্যাপে কিংবা বাড়ির খাবারের পানিতে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে, অনেকক্ষেত্রে মানুষের সহ্যক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি। চীনের কয়েকটি নদীর পানির নমুনায় পাওয়া গেছে প্রায় ৬০ টির বেশি অ্যান্টিবায়োটিক! আমাদের দেশে বুড়িগঙ্গা ও কিংবা শহরসংলগ্ন অনেক নদীর ক্ষেত্রেও এইরকম টা হতে পারে।
অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ সমস্যা পরিমাপের জন্য রয়েছে ওষুধ প্রতিরোধ সূচক (Drug Resistance Index), এই সূচকের মান ০ (শূন্য) থেকে ১০০ (একশত) পর্যন্ত হয়, ০ বলতে বোঝায় কোনো প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি, অর্থাৎ সব অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে, এবং অন্যদিকে ১০০ বলতে বোঝায় জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়াসমূহ পুরোপুরি প্রতিরোধী বা রেজিস্ট্যান্ট। ইউরোপের ২৭টি দেশের মধ্যে ২২টি দেশেই (শুধুমাত্র জার্মানি ও সুইডেন ছাড়া) গত চৌদ্দ বছরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ অনেক বেড়েছে, ক্ষেত্র বিশেষে (যেমন, বুলগেরিয়া) বেশ বিপজ্জনক।
যেভাবে ব্যাক্টেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট (প্রতিরোধী) হয়ে ওঠে
কিছু ব্যাক্টেরিয়া কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে (Antibiotic resistant), আবার অন্য কিছু ব্যাক্টেরিয়া ঐ একই অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা আক্রান্ত (Antiobiotic sensitive) হয়। এমনকি কিছু ব্যাক্টেরিয়া যে কিনা একটি অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, সেও পরিব্যক্তি বা মিউটেশনের (Mutation) মাধ্যমে এমন সব বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে যার ফলে ব্যাক্টেরিয়াটি ঐ অ্যান্টিবায়োটিক রোধী হয়ে উঠতে পারে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যাক্টেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক রোধী হয়ে উঠতে পারে। যেমন:
• ব্যাক্টেরিয়া পর্যাপ্ত পরিমাণে এমন উৎসেচক বা এনজাইম তৈরি করতে পারে যা ঐ অ্যান্টিবায়োটিকটি বিনষ্ট বা পরিবর্তন করে অকেজো করে দেয়।
• অ্যান্টিবায়োটিক যদি কোষে প্রবেশ করতে অক্ষম হয় ও কোষঝিল্লির বাইরে পাম্প দ্বারা বহিষ্কৃত হয়
• অ্যান্টিবায়োটিকের লক্ষ্যবস্তুর গঠন পরিবর্তিত হওয়া অর্থ্যাৎ, জিনগত মিউটেশন, অন্য উৎসেচক ইত্যাদি দ্বারা লক্ষ্যবস্তুর রাসায়নিক পরিবর্তন।
• অ্যান্টিবায়োটিকটি এবং শরীরের কোষ যদি একই গতিপথে পদার্থের সংশ্লেষণের জৈব রাসায়নিক (Biochemical Pathway) বাধা না দেয়।
অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে প্রতিকারে করণীয়
• অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখা, অন্তত যে সব ক্ষেত্রে খুব কম অ্যান্টিবায়োটিক দরকার বা একেবারেই দরকার নাই। মনে রাখতে হবে যেকোন অ্যান্টিবায়োটিক শুধু মাত্র অণুজীবের বিরুদ্ধে কাজ করে; অর্থাৎ যে সকল রোগ অণুজীবের সংক্রমণের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়, সেই সব রোগ নিরাময়ে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে কোনো লাভ হবে না। উপরন্তু দেহে ঐ বিশেষ অ্যান্টিবায়োটিক-রোধী ব্যাক্টেরিয়ার বিস্তার ঘটবে এবং পরবর্তিতে কোনো রোগ ঐ ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা ঘটে থাকলে তখন রোগ নিরাময়ে ঐ অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসবে না।
• ভাইরাসঘটিত রোগে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বন্ধ করা। ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসে না, কারণ অ্যান্টিবায়োটিক শুধু মাত্র ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাকের বিরুদ্ধে কাজ করে। যেমন, আমাদের যে সাধারণ হাঁচি কাশি জাতীয় ঠাণ্ডা লাগা (Common Cold), সেটা মূলত ভাইরাস ঘটিত- করোনাভাইরাস (Coronavirus), রাইনোভাইরাস (Rhinoviurs) ইতাদি সাধারণত দায়ী; এদের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না।
• ঠিক যেই অ্যান্টিবায়োটিক দরকার সেই অ্যান্টিবায়োটিকই প্রয়োজন মাফিক ব্যবহার করতে হবে।
• ডাক্তার যখন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে পরামর্শ দেবে, তখন ডাক্তারের পরামর্শ মতো সঠিক সময়ের ব্যবধানে সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক সময় পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হবে। অর্থ্যাৎ, সম্পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করতে হবে।
• টিবি ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় দুই বা ততোধিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা প্রয়োজন, এতে অ্যান্টিবায়োটিক-রোধী ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাব্যতা অনেকাংশে কমে যায়।
• যখনই কোনো কোনো ব্যক্তির দেহের ব্যাক্টেরিয়া একটি বিশেষ অ্যান্টিবায়োটিক-রোধী হয়ে যায়, তখনই যত শীঘ্র সম্ভব অন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত।
• মেয়াদ উত্তীর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন না করা।
আরও পড়ুন: থাইরয়েড সমস্যা; যা জানা প্রয়োজন
তথ্যসূত্র: এনএইচএস, উইকিপিডিয়া, বিজ্ঞানব্লগ