গল্প

ব্যান্ডপার্টির হালিম

ব্যান্ডপার্টিরব্যান্ডপার্টির

ব্যান্ডপার্টির হালিম

হাসি হাসি মুখের ভাল মানুষ টাইপের একটা বাঘের মুখোশ পরে লোকটা ড্রাম বাজাচ্ছিল। কখনও নাচ দেখিয়ে কখনও পেরেক পোতা কাঠের উপর শুয়ে ম্যাজিক দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছিল সমবেত উৎসুক জনতাকে। না , আজকের কথা বলছি না মোটেও —সেই যে , যেবার বিয়ে হল সুজিতদার, সেই তখনকার কথা বলছি। ব্যান্ডপার্টির সাথে আমার প্রথম পরিচয়ও হয় সেই তখন।

ফাল্গুন মাস, গ্রামে বিয়ের যেন ধুম লেগেছে। বিভিন্ন গায়গা থেকে বাজি-বাজনার শব্দ হঠাত হঠাত বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থায় পড়াশুনায় মন বসানোর মত অত বেজায় ভাল ছেলে আমি নই—- আমার ছোটাছুটির বিরাম নেই, পড়াশুনো মাথায় উঠল। কোন বাজিয়ে কেমন বাজায়, কে ভাল ম্যাজিক দেখাতে পারে এসব নিয়ে আমি এত উত্তেজিত ছিলাম যে বড়দার কাছে বার বার বকুনি খেতে খেতে চেনা-অচেনা ভদ্র গোছের গালি গুলো পানসে হয়ে এলো।

এই বাজিয়েদের মধ্যে একটা দল কিন্তু আমার মনে জায়গা করে নিল। দলের অধিকারী আমোদ আলি—– সানাই বাজায়। তার বড় ছেলে হালিম বাজায় সাইড-ড্রাম আর ছোট ছেলে হোসেন বাজায় কর্নেট বাঁশি — তখন এ বাঁশির নাম জানতাম না বলে আমরা বলতাম পেঁচানো বাঁশি। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে শুনতাম হোসেন যখন তার বাঁশিতে বাজাতো হালের মিষ্টি সুরের হিন্দি গান কিংবা পুরনো দিনের বাংলা গানের সুর। অপূর্ব দক্ষতায় হালিম সে বাঁশির তালে তার সাইড-ড্রামের মিহি সুরের মিলন ঘটিয়ে মুগ্ধ করে দিত সকলকে।

মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসে বইয়ের লেখার ভিতরে হারিয়ে যেতাম। কেরোসিনের কুপির আলোয় সন্ধ্যেবেলায় আমাদের বই পড়ার মহোৎসব চলত। উচ্চস্বরে দুই তিনজন মিলে এভাবে সুর করে বই পড়ার ভীষণ বাণী রাশি, রাস্তা দিয়ে যাওয়া পথিকের কাছে বর্ষায় গ্রামের পুকুরে ব্যাঙের দলের কলরোল বলে মনে হত। এরই ফাঁকে বইয়ের লেখা ছাপিয়ে কখন যে হাকলবেরি ফিনের সাথে একাত্ম হয়ে ঘর ছেড়ে বের হতাম টেরও পেতাম না। পড়ার টেবিল ছাড়িয়ে জনমানব বর্জিত সেই কল্পনার দ্বীপে তাবু গেঁড়তাম! ফিন মধুর সুরে বাজাতো বাঁশি আর আমি উন্মাদের মত সে সুরের সাথে বাজাতাম সাইড ড্রাম। হঠাৎ দাদার কলমের খোঁচায় টেবিল বাজানো বন্ধ করতে হতো!

গভীর রাতে আমাদের শিরিশ গাছের ডালের ফাঁকে চাঁদ উঠত, মনে হতো নির্জন রাতের দেয়ালে চাঁদটা লেপ্টে আছে। বাড়ির পাশে পশুরের জলে সে ঠান্ডা চাঁদের সাদাটে আলো রাতকে যেন মৃতের ছোঁয়া এনে দিত। কখনও মাঝ রাতের নির্জনতা ভেঙে নদীতে যেত মালবাহী কার্গো। যান্ত্রিক শব্দ মিলিয়ে যেত বটে কিন্তু অনেক দূর থেকেও সে কার্গো থেকে ভেসে আসতো আলতো সুরে পুরনো বাংলা গান — “ রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে, ঘুম ঘুম নিঝুম রাতের মায়ায়”। অদ্ভুত ভাল লাগায় আর কী এক দুর্বোধ্যতায় সে রাতের ঘুম যেত ছুটে। মনের কোণে রঙ্গিলা বংশীবাদক চির-রাখাল কানাই যেত ব্রজের পথে হারিয়ে, থাকতো হাকলবেরি ফিন – হাতে যার পেঁচানো বাঁশি; তার সে সুরের সাথে সাইড-ড্রাম বাজাবো বলে মন আমার হয়ে উঠত উতলা।

ব্যান্ডদলের সুরে প্রভাব আমার ঘাড়ে ভূত হয়ে চেপে ছিল বহুদিন। কালক্রমে আমি শহরে এসেছি, পড়ালেখাও শেষ। সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি তাই গ্রামে খুব একটা যাওয়া হয়ে ওঠে না। শহরে বিচিত্র সুরের অভাব নেই তবুও কোথাও ব্যান্ডদলের বাজনা শুনলে আমার মন উৎসুক হয়ে উঠত। আমোদ আলির সেই দলটার কথা হঠাৎ মনের ভিতর ছেলেবেলার সেই সব স্মৃতিকে জাগিয়ে যেত, কিন্তু কালক্রমে তাও ভুলে যেতে বসেছিলাম।

এবার শীতের শুরুতে আমার কাকাতো ভাইয়ের বিয়ে। সবার পীড়াপীড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি গেলাম। বহুদিন পর গ্রামে ফিরলে যা হয় আর কি, সেই পুরনো আড্ডায় ডুবে যেতে বেশি দেরি হল না। বিয়ে বাড়ি মানেই একটা আনন্দের আমেজ চারিদিকে কাজকর্ম, মাতব্বরি ইত্যাদিরও হিড়িক। এ সব কাজকর্মে ফাঁকি মেরে নির্ভেজাল আড্ডার জন্য আর কতকটা হট্টগোল থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমরা জনা পাঁচেক মিলে একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে গেলাম তাস নিয়ে। আর পায় কে!

বেশ নিমগ্ন হয়েই খেলছিলাম কিন্তু চমকের মত কান চলে গেল একটা সুরের দিকে। আমাকে চমকে দিয়ে হোসেনের সেই বাঁশি গেয়ে উঠলো অতি চেনা সুর, “ ও গোলাপ ও মালতী, তুমি তেমনই আর আছ কি?” বহুদিন পর পিপাসা নিবৃতির মত হোসেনের বাঁশির সুরে কান পাতলাম। কিছুক্ষণ কান পেতে শোনার পর কেমন যেন ভাল লাগা মরে যেতে লাগল। অবাক ব্যাপার, হোসেনের সেই সুর আর কই? তবে কি হোসেন তার সেরা সময়টাকে পেছনে এসেছে, নাকি দীর্ঘদিনের উতকণ্ঠায় আমারই ভাললাগা ফুরিয়ে গেছে? নাহ, সেই সুর যেন এ নয়, কিছুতেই এ সুর আমার মনকে আর ছুঁয়ে যেতে পারলো না।

বরযাত্রী হলাম। কণের বাড়ি আমাদের সে সর্বপরিচিত আমোদ আলির গ্রামেই। এতে অবশ্য ব্যান্ড দলেরই সুবিধা হয়েছে বেশি— বাজানো শেষে তারা নিজেদের বাড়িতে আরামে ঘুমানোর সুযোগ পেয়েছে। বরযাত্রী হলে অনেক সময় দুর্ভোগের সীমা থাকতো না। অনেক লোকের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করা কণের বাপের পক্ষে কন্যা সম্প্রদানের মতই চিন্তার বিষয় হয়ে উঠতো। অবশ্য তাতে আমাদের মত চ্যাংড়াদের বেশি চিন্তা ছিল না, তাসের আড্ডায় গল্পে গল্পে রাত ফুরাতো সহজে— এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।

সকালবেলায় কন্যাকে বরের সাথে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার দুঃখে চারিদিকে কান্নার রোল পড়ে গেল। যে যেখানে যেভাবে পারে কেঁদে কেটে বাতাস ভারী করে তুললো। পরিবেশটা এমন ভারী হয়ে উঠলো যে আমরা বিব্রত বোধ করতে লাগলাম। অবশেষে বিরক্ত হয়ে আমরা সেই তাসের আসরের সবাই মিলে বাড়ি যাওয়ার পথের দিকে এগিয়ে এসে একটা চায়ের দোকানে বসলাম স্বস্তির আশায়। গল্পে গল্পে চা খাওয়া যখন শেষের দিকে তখন বরযাত্রীর দল কণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাদ্য সহযোগে ঘরমুখো হয়েছে। আমোদ আলির সানাই আমদের সামনে দিয়ে প্যাঁ প্যাঁ করতে করতে মিলিয়ে যেতে লাগলো বরযাত্রীসহ। যাক গে, আমরা বসে থাকলাম —- আরেকটু দূরে যাক তারপর আমরা যাবো।

উঠবো উঠবো করছি এমন সময় দেখি একটি লোক লোক লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যথাসম্ভব দ্রুত এসে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালো। তার চোখ দুটো পলকহীন হয়ে ঐ বিদায়ী বরযাত্রী দলের দিকে তাকিয়ে। পাশ কাটিয়ে চলে আসার সময় হঠাৎ আমার চোখ পড়ে গেল তার দিকে, কেমন যেন চেনা চেনা লাগলো মুখখানা। মনের খটকা মিটাতে এগিয়ে এলাম কাছে — আমার দিকে তাকাতেই লোকটির মুখে চিনতে পারার আগ্রহ, আমিও চিনলাম তাকে — এ যে হালিম!

কোনমতে থোতলিয়ে হালিম আমাকে যা বললো তা সহজে বললে এমন দাঁড়ায়, “ ছোড়দা, ভাল আছ?”
আমি বললাম, “ ভাল তো আছি কিন্তু একি, তোমার এ হাল কেন?”

এ কথার জবাব হালিমের কাছে মিললো না, সত্যি বলতে কি জবাব দেয়ার মত যথেষ্ট বাক-শক্তি তার ছিল না। গতবছর স্ট্রোক হয় হালিমের, তারপর থেকে সে পঙ্গু এবং প্রায় বাক-শক্তিহীন। আমার সাথে কথা বলার ফাঁকে দেখলাম তার চোখ চলে গেছে দূরে বিলীয়মান ব্যান্ডদলের দিকে, যেখান থেকে হোসেনের কর্নেট বাঁশির সুর ক্রমশ অস্ফুট। অস্ফুট সে সুরের সাথে সঙ্গত দেওয়ার বাসনায় অসহায় হালিমের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল। আমিও তাকালাম সুরে সুরে মিলিয়ে যাওয়া ব্যান্ডদলের বিদায়ী পথের দিকে— সত্যিই তো! কাল থেকে যেন কীসের অভাবে ঐ ব্যান্ডদলের কাছে ঘেঁষার টান বোধ করিনি আমি।

সংগৃহীত ও সর্বশর্ত সংরক্ষিত বিকাশ রায়

আরও পড়ুন ফার্স্ট ক্লাস এর যাত্রী

Leave a Reply

%d bloggers like this: