লকডাউন ভালোবাসা
আমি লকডাউন এর এই ক’দিনে বেশ টিপটাপ করে থাকি, চুলে ব্রাশ লাগাই অন্তত দুইবার, একটু লিপস্টিক দেই, চোখে কাজল টানি, পরিপাটি করে শাড়ি পরি আর বার বার আয়নার সামনে দাঁড়াই, নিজেকে দেখি। অথচ বিয়ের এই পনেরো বছরের মধ্যে প্রথম বছর ছাড়া আমার মনে পড়েনা একদিনে এত বার আয়নায় নিজেকে দেখেছি কিনা। নাহ! একেবারে চেহারা নষ্ট হয়ে যায়নি, বেশ সুশ্রী চেহারা আমার, কিন্তু যত্নের অভাবে কেউ দেখে বুঝতেই পারেনা যে আমি এত সুন্দর!
আমার এই সৌন্দর্য ঢাকা পড়েছে আমার ব্যাস্ততায়, ঘরকন্যার কাজের চাপে। চার সন্তানের মা হয়ে সময় কোথায় নিজেকে নিয়ে ভাবার। তার উপর আমার স্বামীর পুরো দেখাশোনা এই যেমন কাপড় পরিপাটি করে রাখা, জুতো গুছিয়ে রাখা, কোন শার্টের সাথে কোন টাই প্যান্ট যাবে সে খেয়াল রাখা, কি খাবে দুপুরে লাঞ্চে অফিসে সেটা প্যাক করে দেয়া ইত্যাদি। ও খেতে বসলে ওর পাশে থাকতে হয় আমাকে, পানি ঢেলে দেয়া, লবণ এগিয়ে দেয়া, প্লেটে ভাত তরকারি তুলে দেয়া এগুলোও আমি দেখি। বাসায় কাজের বুয়া আছে কিন্তু তার হাতের রান্না আমার স্বামী খাবেন না। বলে, যদি বুয়ার হাতের রান্নাই খাবো তো বিয়ে করেছি কেনো। আমিও অতি আনন্দে তার পছন্দের সব পদ রান্না করে টেবিলে সাজিয়ে দেই, মাছ- মাংশ যতই থাকুক ভর্তা তার লাগবেই এক পদের না কয়েক পদের। এসব করতে করতে আমার জন্য আর সময় তুলে রাখতে পারিনা। তাই নিজের সখের কাজগুলো করা তো দূর, ঠিকমতো নিজেকে গুছিয়েও রাখতে পারিনা। তাইতো আমার স্বামীও বলেন, ‘যে রাঁধে সেতো চুলও বাঁধতে পারে, তুমি পারোনা এটা তোমার ব্যর্থতা। দেখো আমার বান্ধবীরা কেমন করে নিজেদের পরিপাটি রেখে ঘর সংসার গুছিয়ে করছে, ফেসবুকে তাদের রান্নার ছবি তো দেখিয়েছি তোমাকে, বলো তারাও তো মেয়ে’! সত্যিইতো! আমি কেনো পারিনা আমার স্বামীর বান্ধবীদের মতো হতে।
অথচ বিয়ের আগে আমি একেবারেই অন্যরকম ছিলাম, সব বিশেষ দিনে আলাদা বাজেট থাকতো শাড়ি কেনার জন্যে, আমার বাবা টাকা দিতেন আমার শখ পূরণের জন্য। বৈশাখে সাদা লাল শাড়ি পরে দুই হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি আর বড় একটা টিপ পরা আমার লাগবেই, পহেলা ফাল্গুনে বান্ধবীদের সাথে হলুদ শাড়ি আর গাঁদার মালা পরে সারাদিন ঘুরেছি। একুশের বইমেলায় ইচ্ছে মতন বই কিনতাম কখনো গুনতাম না কতগুলো কিনেছি। আমার খুব শখ ছিল নিজস্ব একটি লাইব্রেরি হবে, তাই বাবা তার স্টাডি রুমের পাশে একটি ছোট রুম করে দিয়েছিলেন লাইব্রেরি করার জন্য। আমার মনে পড়ে মোট দুই হাজার ছত্রিশটা বই আমার আছে সেখানে।আমি যখনই সময় পেতাম বই নিয়ে থাকতাম, একই বই হয়তো কয়েকবার পড়ে ফেলেছি কিন্তু যতবারই পড়ি নতুন লাগতো। আমার বিয়ের পর বাবা বললেন, তোর লাইব্রেরি নিবিনা তোর সাথে? আমি বললাম, বাবা নিবো অবশ্যই কিন্তু এখন তো আমাদের ঘর ছোট, যেদিন বড় ঘর হবে সেদিন সবগুলো বই নিয়ে যাবো। তখন থাকতাম চিলেকোঠার এক রুমের বাসায়, খুব ছোট তবে দুইজনের চলে যেতো।
চিলেকোঠার সংসার হলেও সেখানে অনেক আনন্দ ছিল, বিয়ের প্রথম বছরের কথা বলছি। খুব দেরি করে ঘরে ফিরতোনা আমার স্বামী , সন্ধ্যায় চলে আসতো আর আসার আগে ফোন দিতো এক সাথে চা খাবো বলে। আমি ওর আসার অপেক্ষায় ছাদের রেলিং-এ দাঁড়িয়ে থাকতাম একটা টাঙ্গাইলের সূতি শাড়ি পড়ে, চুল আঁচড়ে আর একটা বড় টিপ পরে। ও প্রায় দিনই আমার জন্য ফুল নিয়ে আসতো কখনো গোলাপ, কখনো বেলি ফুলের মালা আবার কখনো দোলন চাঁপা।আবার মাঝে সাঝে আমাকে ফুল পরিয়েও দিতো চুলে। টাকার অভাবে আমাদের হানিমুনে যাওয়া হয়নি বিয়ের পর কিন্তু সেই চিলেকোঠার এক বছরের সংসারই আমার কাছে হানিমুন ছিল। আমরা চাঁদনী রাতে ছাদে শুয়ে চাঁদ দেখতাম আর হাতে হাত রেখে ভবিষ্যতের কথা বলতাম, কি করবো যদি টাকা হয়, বিদেশে যাবো বেড়াতে, একটা বড় বাসা নেবো যেখানে আমার লাইব্রেরিটা নিয়ে আসতে পারবো আর আমাদের বাসায় মেহমানদের নিমন্ত্রণ করবো, তাদের রাতে থাকতেও বলতে পারবো।
বিয়ের এই পনেরো বছরে আমাদের অনেক টাকা পয়সা হয়েছে, বিশাল সাইজের নিজেদের ফ্ল্যাটও হয়েছে আমার স্বামীর পরিশ্রম আর আমার একাকীত্বের বিনিময়ে। ও এত বেশি ব্যাস্ত হয়ে পড়লো যে আমাকে সময় দিতে পারতোনা, গভীর রাতে বাসায় ফিরেও তার কাজ ফুরোয় না। আমি রাতের পর রাত জেগেছি তার অপেক্ষায়, কিন্তু সে এসে খেয়ে দেয়ে নিজের মতো ব্যাস্ত ফোনে তার ব্যাবসার কাজে। এরই মাঝে সংসার বড় হয়েছে, আমাদেরও বয়স হয়েছে, কিন্তু শুধু মনে হয়েছে ধীরে ধীরে ও আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমি কত বার কত ভাবে বলতে চেয়েছি আজো আমি তাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যেতে চাই, আজো আমি তাকে নিয়ে বৈশাখ-ফাল্গুন পালন করতে চাই কিন্তু তার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। সে তার বন্ধু বান্ধবীদের যেটুকু সময় দেয় আমাকে তার সেই সময়টুকুও দেয়না। আমি প্রথম কয়েকবছর চেষ্টা করে পরে বুঝে গেছি, নাহ এভাবে অপেক্ষায় হবেনা। তাই অপেক্ষার পালা শেষ করে আমার সন্তানদের মানুষ করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম, নিজের অস্তিত্ব ভুলে গেলাম, আমিও যে রক্ত মাংসের এক মানুষ আমারো যে ইচ্ছে করতে পারে জীবন উপভোগ করতে বেমালুম ভুলে গেলাম। কার জন্য সাজবো, কার জন্য নিজেকে গুছিয়ে রাখবো, সেতো তার জীবনে আমার উপস্থিতি মনে হচ্ছে টেরই পায়না।
অবশেষে এতগুলো বছর পরে লকডাউন এর কারণে এই কয়েক সপ্তাহ সে একটানা বাসায় আছে ,কারন বের হওয়ার উপায় নাই সবকিছু বন্ধ। লকডাউন চলছে দেশ জুড়ে করোনা ভাইরাসের জন্য। আমি আবার উপলব্ধি করছি তার জীবনে আমার উপস্থিতি। সে এখন আমার খোঁজ খবর নিচ্ছে, লকডাউন এর কারণে আমার কাজের বুয়া নাই দেখে নিজেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সে সারাদিন বাসায় থেকে দেখছে এবং বুঝছে কত পরিশ্রম সারাদিন করছি চারটা সন্তান দেখাশুনা করতে আর সংসার সামলাতে। যে কখনো পানি ঢেলেও খেতোনা, একদিন দেখি খুব সকালে সে দুই কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসে বলল চলো দুইজনে বারান্দায় বসে চা খাই। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে। আরেকদিন হঠাৎ সে বলল ‘আজ একটা টাঙ্গাইলের সূতি শাড়ি পরো, সাথে টিপও দিও, অনেক দিন তোমায় দেখিনা শাড়িতে। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকলো আর ভাবতে লাগলাম তাহলে সে আমায় ভুলেনি একেবারে, এখনো ভালোবাসা আছে অবশিষ্ট। তাই আমি এই লকডাউন এ আবার নতুন করে একটু একটু করে আমার নিজেকে উদ্ধারের কাজে সচেষ্ট হতে লাগলাম, নিজেকে গুছিয়ে রাখতে ভালবাসতে শুরু করলাম। লকডাউন এর এই সময়ে আমার ভালোবাসার মানুষটিকে আবার আমার নিজের কাছে ফিরে পেলাম।।