মায়ের বিয়ে- মা দিবসের গল্প- (মায়ের ভালবাসার ছোট গল্প )
আজ আমার মায়ের বিয়ে। মায়ের পরনে হালকা গোলাপী রঙের এই শাড়িটা আমার পছন্দেই কেনা। গোলাপি রঙ মায়ের ভীষণ পছন্দের। আর বিয়ের অন্য সব আয়োজন আমিই করেছি। আয়োজন বলতে বিয়ে কোন কাজী অফিসে হবে,সাক্ষী কে কে থাকবে এইসব আরকি। আমরা দুভাই। বড় ভাইয়ার এই বিয়েতে ভীষণ আপত্তি। দুতিনদিন বাসায় এসে গোলমাল করে গেছে। ভাইয়া আমাদের সাথে থাকেনা। বিয়ের পর আলাদা হয়ে গেছে। যোগাযোগ রাখেইনা একদম। অথচ মায়ের বিয়ের কথা শুনে হঠাৎ সম্পর্কের সূতা ধরে টানতে লাগলো। তার নাকি মুখ দেখানো কঠিন হয়ে যাবে সমাজে।
বড় ভাইয়া বরাবরই মায়ের আদরের। মাছের মাথা,মুরগীর রান এসব বরাবর ভাইয়ের থালাতেই যেতো। বাবার কাছে লুকিয়ে ভাইয়ার শখ পূরণ করতে দেখেছি মাকে। অথচ এই ভাইয়া বিয়ের পর ছোট একটা বিষয়ে আমার আর মায়ের সাথে সব সম্পর্ক বলতে গেলে শেষ করে চলে গেলো। ভাবীকে নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করলো। মাকে সরাসরি বলে দিলো, “তোমাদের সাথে আমি কোনোরকম কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইনা। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও তোমরা। এখন বুঝতে পারছি তোমার জন্যই বাবা এমনটা করেছেন।” হ্যাঁ, আমরা যখন ছোট তখন একদিন হঠাৎ করেই বাবা নিখোঁজ হন। অনেকদিন পর জানতে পারি উনি অন্য শহরে নতুন করে সংসার পেতেছেন।
আমার মা। গরীবের সংসারে পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সেজো। শ্যামলা বরণ আর মিষ্টি চেহারার মা আমার ঠিক যেন দেবি দূর্গা। বয়সে বড় আমার বাবার সাথে আমার দাদা পছন্দ করে বিয়ে দেন। তবে বিয়ের পর স্বামীর ভালোবাসা পাননি কখনও। শ্যামলা রঙ আর গরীব ঘরের হবার কারণে বাবার মাকে পছন্দ হয়নি মোটেই। শুধু দাদার জেদে বিয়ে করেছিলেন উনি। সংসার করতে হবে বলেই করেছেন। বাইরে একাধিকজনের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো। ব্যবসার সুবাদে প্রায় সময় বাইরে যেতেন। রাতে ফিরতেননা। ছোটখাটো কারণেই মার গায়ে হাত তুলতেন। এসব আমার চোখে দেখা। খুব কষ্ট হোতো যখন দেখতাম মা আঁচলে মুখ চেপে কান্না করতেন।
যেদিন বাবা চলে গেলেন মার চোখে সেদিনও পানি ছিলো। অবাক হয়েছি,যে মানুষটা কখনও তাকে মানুষ বলেই গণ্য করেনি তার জন্য মা কে এভাবে কাঁদতে দেখে। হয়তো মাথার ওপর থেকে একটা ছায়া সরে গেলো,ছেলেদুটো বাবা হারালো এইভেবে মা খুব ভেঙে পড়েছিলেন। দুছেলেকে বুকে জড়িয়ে রেখেছেন। মানুষ করেছেন। তবে ভাইয়ের দেয়া আঘাত মাকে বেশি কষ্ট দিয়েছিলো।মা এত বেশি ভালোবাসতেন ওকে যে এভাবে পর হয়ে যাবে এটা মেনে নিতে পারেননি। ভাইয়ের জন্মদিনে মা আমাকে লুকিয়ে ওর প্রিয় ছানার পায়েস রান্না করে নিয়ে গেলো। ভাবি সেই পায়েস মায়ের সামনেই কাজের বুয়াকে দিয়ে দিলো। ভাইয়া চুপ করে ছিলো। ভাবী চরম অপমান করে মাকে তাড়িয়ে দিলো সেদিন।
মা এর ব্যাপারটা কেনো জানিনা খুব কষ্ট দিতো আমাকে। একটা মানুষ যার পুরো একটা জীবন এভাবে চলে গেলো। কাছের মানুষ ,আপন মানুষ বলতে কেউ থাকলোনা জীবনে। কানাডায় একটা স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেছিলাম। সেটাতে আমাকে সিলেক্ট করেছে। দারুণ খুশির একটা সংবাদ। মা ভীষণ খুশি। তবে আমার কোথায় একটা মনখারাপ। আমি চলে গেলে মা এর কি হবে। একদম একা হয়ে পড়বে মা। কি করবো ভেবে কুলাতে পারছিলামনা।
সেদিন সকালে কি একটা দরকারে নানা বাড়ি গেছে মা। আমার একটা সার্টিফিকেট খুঁজতে গিয়ে মা এর আলমারিতে একটা পুরোনো ডায়েরি পেলাম। মা ডায়েরি লিখে জানতামনাতো। উচিত হবেনা জেনেও পাতা উলটাতে থাকলাম। বিশেষ কিছু ঘটনার ছোট ছোট বর্ণনা। একটা অনেক পুরোনো চিঠি পড়ে গেলো হঠাৎ। অনিক নামের একজন মাকে লিখেছেন,
“নীলা,তোমাকে ছাড়া জীবনটা কিভাবে কাটবে সেটা জানা নেই। তুমি তো তোমার মা বাবার বিরুদ্ধে যাবেনা। তবে আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে জীবনে কল্পনাও করতে পারিনা। সারাজীবন অপেক্ষায় থাকবো। যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকি একদিন ঠিক জীবনে পাবো।” থমকে গেলাম।মাথাটা ঘুরে উঠলো। তার মানে অনীক নামের একজন মাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। হয়তো এখনও বাসেন। মা এর একজন প্রেমিক ছিলো প্রথমে সেটা ভেবে কেমন একটা ধাক্কার মতো লাগলো। তবে পরক্ষণেই মনখারাপ ভাবটা দূর হয়ে গেলো। অনিক নামের মানুষটাকে খুঁজে বের করলাম।
একটা বেসরকারি কলেজের অংকের শিক্ষক। একাই থাকেন। চমৎকার একজন মানুষ। সকলের খুব প্রিয়,পরোপকারী। তবে বিয়ে থা করেননি। দুদিন খুব ভাবলাম। আমি চলে গেলে মার জন্য কে থাকবে। একা হয়ে পড়বে মা। আর একটা মানুষ জীবনে কারো ভালোবাসা পাবেনা এইটা মেনে নেবার মতো না। বাবা যদি সব ছেড়ে নিজের সুখ খুঁজে নিতে পেরেছেন মা কেনো এভাবে সারা জীবন কষ্ট পাবেন।
সিদ্ধান্ত নিলাম মায়ের বিয়ে দেবো। একটা মানুষ জীবনে কিছুই পায়নি। তার জন্য আরো একজন মানুষ জীবনের পুরোটা সময় হারিয়েছে। তাদের দুজন যদি জীবনের শেষ কটা দিন একটু ভালো থাকে তাতে কি সমাজ সংসারের খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যায়। একটু কৌশল এর আশ্রয় নিতে হলো আমায়। মাকে সবটা জানালাম আমার ইচ্ছের কথা। মা কিছুতেই এতে রাজী না। সাফ জানিয়ে দিলাম যদি মা রাজী না হন স্কলারশিপ ক্যানসেল করবো। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিলাম। অসুস্থ হয়ে গেলাম একসময়। মা শেষ অবধি অনিক আঙ্কেলের সাথে দেখা করতে রাজি হলেন। এতদিন পর দুজনের দেখা হতেই মার চোখে অদ্ভুত সুন্দর আলো দেখলাম। বলে বোঝাতে পারবোনা কতটা সুখী লাগছিলো নিজেকে। তিনজন বসে সবটা ঠিক করলাম।
অনেকের অনেক কথার বাঁধা ডিঙিয়ে আজ নিজে আমি মায়ের বিয়ের আয়োজন করেছি। সমাজের কটাক্ষ উপেক্ষা করেছি। জীবনের পড়ন্ত সময় দুটো মানুষ থাকুক না একটু ভালো। সব কিছু তো সবসময় গদ বাঁধা নিয়মে চলেনা। আজ মায়ের জীবনে একটুখানি আকাশ দিতে পেরে সত্যিই ভীষণ খুশি আমি। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পুরো সময়টা মার হাত ধরে বসে আছি আমি। কিছুতেই আর মাকে হেরে যেতে দেবোনা আমি।