শেষ বিদায় (বাবা)
১.
অফিস থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকে শিমুল। ঢাকার সুউচ্চ ভবনগুলোতে তখনো শেষ বিকেলের আভা। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। রংপুর থেকে ফোন দিয়েছে মা। অস্থির হয়ে কথা বলছে – তোর বাবা শেষ বারের মত দেখা করতে চায়। আয় বাবা। বাবা তখন শয্যাশায়ী। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন। সবাই বুঝে গিয়েছে দীর্ঘ দুই বছরের এই যুদ্ধের পরিণতি কী হবে।
দুই সপ্তাহ আগে দেখা করে এসেছে শিমুল। আবার কয়েকদিন ধরেই চেষ্টা করছে যাওয়ার। কিন্তু ছুটি হচ্ছে না। মার কণ্ঠ শুনে সে আর স্থির থাকতে পারেনা। সিদ্ধান্ত নেয় প্রয়োজনে চাকুরি ছাড়বে। কিন্তু বাড়িতে যাবেই। আজ রাতেই!
২.
শোঁ শোঁ করে ছুটছে রাতের কোচ। লাল নীল হলদে রঙের আলো খুব দ্রুত পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার চেয়েও দ্রুতগতিতে ছুটছে মন। তিনযুগ আগের সেই নিঝুম গ্রামের বাড়িতে।
মিষ্টি সকাল। মাত্র সূর্য উঠেছে। বাবা হাঁটছে আর পিছে পিছে শিমুল। গর্বিত আর উচ্ছল মন নিয়ে। সবাই কত সম্মান করে বাবাকে। দুই পাশে দিগন্ত বিস্তৃত পাটক্ষেত। হাঁটতে হাঁটতে ক্ষেতের ভিতরে যায়। মাঠ পেরিয়ে ছুটে আসছে হু হু বাতাস। শিমুলের মন নেচে ওঠে। পাটক্ষেতের লকলকে সবুজ ডগাও নাচতে থাকে সাথে সাথে। বাবা সবুজ পাটশাকের আঁটি তুলে দেন শিমুলের হাতে।
কিংবা হাটবারের সেই বিকেল। সাইকেলের সামনে গামছা বেঁধে বাবার সাথে হাটে যাওয়া। বাবা বাজার করছেন মাছ, পটোল আরো কত কী! আর শিমুল অপেক্ষা করছে কখন সেই কথাটি শুনবে। অবশেষে বাবা একসময় বলতেন- শিমুল, কী খাবি বাবা? সঙ্গে সঙ্গে শিমুল বলতো- রসগোল্লা! গরম রসগোল্লা বাবা!
কিংবা বৈশাখের সেই ঠাঁ ঠাঁ রোদ্দুরের দুপুর! মার কড়া আদেশ বাইরে যাওয়া যাবে না। কিছু সময় পর গুটি গুটি পায়ে চুপটি করে দরজা খুলে বড়শি হাতে ছুট। ধ্যানমগ্ন বকের মত বড়শির ফাতনার দিকে তাকিয়ে আছে শিমুল। হঠাৎ পিছনে খুট করে একটু আওয়াজ। মাথা ঘুরিয়ে দেখে বাবা। আর একটু হলেই ধরে ফেলবে। বড়শি ফেলে ছুট ছুট ছুট। পিছে পিছে বাবা।
৩.
শেষ রাতের কিছু আগে বাস থেকে নামে শিমুল। মফস্বল শহরের কনকনে ঠাণ্ডা। কোন রকমে একটি রিকশা নিয়ে বাসায় আসে। দরজায় অস্থির হয়ে আওয়াজ করে-ঠক ঠক ঠক। মা দরজা খুলে দেন। হাতের ব্যাগ কোন রকমে রেখেই বাবার কাছে ছুটে যায়। বাবা ছোট শিশুর মত পড়ে আছেন বিছানায়। ক্যানসার খেয়ে ফেলেছে গায়ের সব কিছু। মা বলেন- এই যে শিমুল! শিমুল এসেছে।বাবা চোখ খুলে দেখেন। মুখে তীব্র যন্ত্রণা আর হাসির এক অদ্ভুদ ছায়া। কথা বলতে পারেন না। কর্কটের মরণ থাবা কথা বন্ধ করে দিয়েছে।
মা খেতে দেন। কোন খাবারেই রুচি নেই। উঠে পড়ে শিমুল। পাশের রুমে শুয়ে আছে। ঘুম নেই দুই চোখে। কাশি হচ্ছে একটু একটু। হঠাৎ বাবার ঘড়ঘড়ে গলার আওয়াজ। সচকিত হয়ে ছুটে যায় পাশের ঘরে। মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মা বলেন- কালকে তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলছে। কাশি হয়েছে যে তোর। শিমুল দৌড়ে চলে আসে নিজের বিছানায়। অব্যক্ত যস্ত্রণায় সারা শরীর দুমড়ে মুচড়ে যায়। আল্লাহ! বাবাকে ভাল করে দাও।
৪.
দেখতে দেখতে দুইদিন কখন যেন শেষ হয়ে গেল। এই দুইদিন সারাক্ষণ বাবার কাছেই থাকে শিমুল। সব সময় অভয় দেয় ভয় নেই বাবা। কিছু হবে না। এই যে হোমিওপ্যাথি ঔষধ নিয়ে আসছি। খুব ভাল ঔষধ। যদিও জানে বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গেছে। এই জনমের মত।
সেদিন তিনটায় বাস। ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের হয় শিমুল। বাবা শুয়ে আছেন বারান্দায়। পা দুটো যেন পাথর। কিছুতেই নড়ে না। আস্তে আস্তে বাবার কাছে যায় সে। বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বাবাকে বলে- আমি যাচ্ছি বাবা! বাবা চোখ খুলে মৃদু হাসেন। ঘোলাটে চোখে দিগন্তপ্রসারী শূন্যতা। এরপর একটু মাথা নাড়িয়ে অনুমতি দেন । বাবা আর শিমুল দুজনেই জানে এটিই এই জনমের মত শেষ দেখা। আর দেখা হবে না। কোন দিনই না।
বাস ছুটছে হু হু করে। শিমুলের দুচোখ বেয়ে পানি ঝরে অবিরাম। সহযাত্রী একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কিছু না জেনেই পিঠে হাত দিয়ে বলেন- কাঁদে না বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে। শিমুলের কণ্ঠ চিরে রুদ্ধ কান্নার এক বিস্ফোরণ ঘটে। ভদ্রলোক শিমুলের মাথা তাঁর কাধে ধরে রাখেন। ঠিক বাবার মত।
৫.
তিনদিন পর মায়ের ফোন। তোর বাবা আর নেই শিমুল! আবার সেই বাস। শীতের ধুসর বিষন্ন কাকডাকা ভোরের রংপুর। বাবা বারান্দায় শোয়া। নিস্তব্ধ নিথর। হাত দিয়ে পরম মমতায় বাবার মুখটা ছুঁয়ে দেয় শিমুল। নরম তুলতুলে রেশমের মত মুখ। খুব নরম স্বরে ডাক দেয় । বাবা! বাবা! অনেকদিন ঘুমাওনা। ঘুমাও বাবা! ঘুমাও!!!!
আরও পড়তে পারেন মেঘ কিংবা কৃষ্ণচূড়ার গল্প