ছোট গল্প ভাঙ্গনের গান
ভাঙ্গনের গান একটি ছোট গল্প। ক্লায়েন্টের বিশাল লিস্ট দেখতে দেখতে রূপন্তীর কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগলো। সকালে বাসায় ঝগড়া করে বের হয়েছে। সেই নিয়মিত ভাঙ্গা রেকর্ড তুমি বিয়ে করছোনা কেন? তোমার সমস্যা কি? ইদানীং মেজাজ সপ্তমে চড়ে থাকে রূপন্তীর। আজ বের হবার আগে নাস্তার প্লেটটা সজোরে আছাড় মেরে গুনে গুনে আট টুকরো করেছে। এমন তো না যে বাসায় জানেনা ওর সমস্যা কি। বছর ছয়েকের বড় এক ধামড়া ছেলে ঘরে পড়ে পড়ে মোষের মত ঘুমায় তা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই। রুপন্তী খেয়াল করলো ও হাত মুঠি করে ফেলেছে। বেশি রাগ হলে এমন করে ও। ব্যাপারটা ওকে যারা ভাল চেনে তাদের মনে থাকে। ওই সময়ে তারা রুপন্তীকে ঘাটায় না।
তোমার নথটা ভাল হয়েছে রূপু। নতুন কিনেছো?
আতিকের গলা শুনে রূপন্তী ফিরে তাকায়। আতিক ভাই সরাসরি বস ওর। ভাল মানুষ। পড়ুয়া। লোকটাকে ভালোই মনে হয়। কাজ ছাড়া বেশিরভাগ সময় কথা বলেন না, হঠাত দুই একটা বলে বসেন, হয়তো সামান্য কথা কিন্তু শুনতে মিষ্টি লাগে। মন ভাল করে দেয়। অনেক মন মরা মেঘ মেঘ দিনের পর যেন এক টুকরো ভোরের মিঠে রোদ। রূপন্তী হেসে ঘাড় কাত করে। আতিক ভাই আলতো করে পিঠ চাপড়ে দেন। রূপন্তীর ভাল লাগে।
সাতাশের কাছে বয়সের ঘড়ি চলে আসায় মন মেজাজ সবসময় এক রকম যায়না। কে যেন বলেছিলো থার্টি ইজ দ্য নিউ টোয়েন্টি… ওর মাথা। চোখের কোলে কালির সাথে সাথে দুই একটা রিঙ্কেল দেখা যাচ্ছে, চুল ও পাকলো কয়েক গাছি। ওয়ার্ক স্ট্রেস দায়ী শুধু তা না। স্ট্রেস দেবার জন্য আরেক বান্দাও আছেন। রূপন্তী ঘড়ি দেখে। ছ’টা বাজতে চলেছে। এক্ষুণি বের হতে হবে। বনানী থেকে মিরপুরের যাত্রা শুভ হয়না কখনো। সময় মত বের না হতে পারলে দু ঘন্টার জ্যাম খেতে হবে। সেটা সুখকর না।
নাবিলের সাথে ব্রেক আপের তিন মাস চলছে। ওরা ছিল হাই স্কুল সুইটহার্ট। এই সিদ্ধান্ত নিতে রূপন্তীর খুব কষ্ট হয়েছিল কিন্তু সময়ের সাথে সাথে খরস্রোতা নদীতেও চর পড়ে যায়। ওর দিক থেকে অনেকটা করেছে। ও নিজে বলে না। সার্কেলের সবাই বলে। ইউনিভার্সিটির এক বছর মিস দেয়া, অকারণে এমবিএ টা ডিলে করে শেষ করা। রূপন্তী এসাইন্মেন্ট করতো আর নাবিল করতো ড্রাগ। জীবনের অনেক গুলো প্রথম নাবিলের সাথে ছিলো ওর। প্রথম কারো হাত ধরা, প্রথম কাঁধে মাথা রেখে সূর্যস্নান দেখা, প্রথম মারিজুয়ানার স্বাদ নেওয়া। সব শুরু যার সাথে হলো তার সাথে শেষ টানতে পারলো না। নামী একটা ব্যান্ডে গিটারিস্ট ছিল নাবিল। প্রথম প্রথম ও বলতো এসব আধ একটু করতে হয়। রূপন্তীর মনে হতো করুক। নাবিল মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতো। রুপন্তী তাও ভাবতো হারাক। ফিরে শুধু ওর কাছে এলেই হলো।
অপেক্ষার প্রহর গুলো কঠিন। প্রতিবার ফিরে এলে রুপন্তী শক্ত করে হাত আঁকড়ে বলতো এবার শেষ, চলো বিয়ে করে ফেলি। নাবিলের কাঁধ পেরোনো ঝাঁকড়া চুল ছিলো রুদ্রর মত। ওর মতোই অট্টহাসি। রুদ্রর মত করেই বলতো- তুমি বরং কুকুর পোষ।
ও পোষ মানবে রূপু। আমার সংসার মানায় না। আমরা বরং বিবাগী হবো। আগেরদিনের বোষ্টমদের মত। আমাদের কর্পোরেট ঘর হবেনা রূপু। আমরা উড়ে বেড়াবো। জলের গানের মত বলবো না এমন যদি হতো… আমাদের সংসার এমনই হবে, কেমন?
রূপন্তী চোখের কোল থেকে নামা পানি অল্প করে মুছে নিয়ে মাথা নাড়তো। রূপন্তীর একটা ছোট্ট ঘরের শখ ছিল। দুই রুমের বাসা। ছাদ ভর্তি থাকবে ঘন কাশবনের পেইন্টিং, ঘরের ফার্নিচার হাঁটুর উপরে যাবেনা। ঘরে ঢালাও বিছানা আর সেই বিছানায় দুটো প্রাণী। রূপু আর নাবিল ।
তারপর ও সংসার হলো না। কর্পোরেট হোক অথবা ছন্নছাড়া। সংসারটা হলো না। নাবিল নিজের সুখ খুঁজে নিলো ধোঁয়ায়, মাঝে মাঝে আঁধার ফুরে বের হতো। আস্তে আস্তে তাও কমে গেলো। শুধু ভালবাসলেই ঘরবাঁধা যায়না এই বাজে সত্যিটা উপলব্ধি করতে একটু দেরী হলেও নাবিলের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো। বাসায় বিয়ে করতে বলে, সব ছেলেকে দেখতে রূপন্তীর মনের অজান্তে কম্প্যারিজন চলে আসে। কাঁটা চামচটা নাবিল হয়তো এভাবে ধরতো না, পার্ফিউমের কড়া গন্ধ ভাল লাগেনা বলে নাবিলের গা ঘেষে পুরুষালী গন্ধ ছিল, চা হয়তো নাবিল শব্দ করে খেতো না।
রূপন্তী মাথা ঝাড়া দিয়ে ফেলতে চায়। এরপর ও সব উঁইপোকার মত বিজবিজ করতে থাকে। লিফটে উঠে লাল মার্ক করা ইংরেজি অক্ষর G (জি) তে চেপে ধরে। লিফটের কপিকল ঘুরতে থাকে সেই সাথে রূপন্তীর মনে চিন্তার চাকাও ঘোরে।
ড্রাগের টাকা জোগাতে নাবিল পড়াশোনাকে ছেটে দিলো জীবন থেকে। একই রকম ভাবে রূপন্তী কেও। যখন সংগ প্রয়োজন হতো কোথা থেকে এসে সামনে দাঁড়াতো। তারপর আবার নেই। টেকেন ফর গ্রান্টেড মনে হয় একেই বলে। পৃথিবীর কাছে রূপন্তী নাবিলকে দোষী বললো না, নিজেকেও দোষী বললো না। শুধু বললো প্রেম মরে গেছে। অকালের তেমন কিছুই তো টিকেনা তাইনা?
পুরোনো একটা পুকুর ছিলো ওদের পরিচিত। মাঝে মাঝে সেই পুকুড়ের ভাঙ্গা ঘাটে দুইজন বসতো। সেই জলের ঝাঁপটায় একটু করে ভিজে যাওয়া মনটার ক্ষত শুকাচ্ছেনা রূপন্তীর। বাসায় দুজনের কথা জানতো, মা বলেছিলো আর যাই করো এমন কিছু করোনা যাতে ছেড়ে এলেও একটা দাগ থেকে যায়। আমার মেয়েকে আমি চিনি । ঐ দাগ মুছতে পারবে না বোধহয়। নাবিলের মাও কথা বলেছিলেন। রূপন্তীকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন –
‘ আমি কাউকে বলতে পারিনা আমার ছেলেটা তো খারাপ না। ভুল করেছে ফেলেছে, মানুষই তো ভুল করে। সবাই ওকে ছেড়ে যায়, আমি তো মা, যেতে পারি না, বুঝলে? ‘
নাবিল পর পর বেশ কয়েকবার রিহ্যাবে গেলো কিন্তু শুধরালো না। রিহ্যাব থেকে ছাড়া পাবার পর ও দেখা হতো না। নাবিল না চাইলে তো হতোইনা, চাইলেও হতো না। খোঁজ টুকু ঠিকই রাখতো রূপন্তী। নাবিল ভাত খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, আবছা ধোঁয়ায় আবার আবার হারাচ্ছে। খোঁজ রাখার দায়িত্বে অবহেলা করেনি না রূপন্তী। মাঝে মাঝে ছোট্ট মেসেজ আসতো ওর ফোনে।
“উই আর নাও নো ওয়ান।“
রুপন্তীর প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওর মনে হয় কবির মত করে জীবন কে নিয়ে কেউ ভাবেনি আর। নাবিল চলে গেলে কবিও হারিয়ে গেলো জীবন থেকে। খুব প্রেশারের একটা চাকুরীতে ঢুকে মনে হলো দম নিতে শিখলেও মাথার ভেতর বোষ্টমীর সংসার ঘুরে, পোষাক বেয়ে কর্পোরেটতা। রুপন্তীর মাঝেমাঝে মনে হয় ও কেবল ছুটছে কিন্তু ছুঁতে পারছে না।
শরৎচন্দ্র রূপন্তীর জীবনে সত্যি হয়ে গেলো। এল আরও একটি ভাঙ্গনের গান, হৃদয় বিদারক কিছু অগোছালো জ্বালা।
বড় প্রেম শুধু কাছেই টানেনা দূরেও সরিয়ে দেয়।
সুত্রঃ নূহা চৌধুরী